Youngali Story, History, Solution, Picture, Song, Video, Scandels and Romance

Youngali Story, History, Solution, Picture, Song, Video, Romance......any thing for your one friend.

Tuesday, November 10, 2009

বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ - গ্লোবাল অর্থনীতি

বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ নিয়ে লেখার ইচ্ছা অনেক দিনের। কিন্তু প্রসঙ্গের ব্যাপ্তি আর ব্লগের সীমিত পরিসর - এই দুই ভাবনায় সবসময় পিছু হটেছি। দেখা যাক এবার সফল হতে পারি কী না! এই লেখা স্বভাবতই পর্বে ভাগ করে আগাতে হবে। সেই সাথে পাঠকের মন্তব্যের সঙ্গে একটা ইন্টারএকটিভ জবাবের সুযোগে আরও অনেক কথা বলার সুযোগ নিব। এখানে প্রথম পর্বটা প্রসঙ্গের পরিচয়মূলক, যাতে পাঠককে প্রসঙ্গে টেনে আনতে পারি, সে উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয় পর্বটা হবে, ১৯৪৪ সালে কী পটভূমিতে প্রতিষ্ঠান দুটো জন্ম নিচ্ছে তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। জন্ম উদ্দ্যেশের ধারণা পাওয়া যাবে তাতে। এর ফাঁকে কোথাও বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ প্রতিষ্ঠান দুটোর আন্তর্সম্পর্ক বলে নিব। তৃতীয় পর্বে থাকবে আইএমএফ গঠন ও বিস্তার প্রসঙ্গ। চতুর্থ পর্বে আসবে বিশ্বব্যাঙ্ক, তার ক্রম পরিবর্তন .... এভাবে। কমপক্ষে সপ্তাহে যেন একএক নতুন পর্ব হাজির করতে পারি সে পরিকল্পনা আছে, চেষ্টা করব।

প্রথম পর্ব:
প্রসঙ্গটা বিশাল। বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ নিয়ে সব মিডিয়ায় যেমন ব্লগেও প্রায়ই একে বিষয় হতে দেখা যায়। মূলত বিভিন্ন মিডিয়ায় যারা অর্থনৈতিক রিপোর্টের কাজের সঙ্গে জড়িত আবার, এই ব্লগেরও সদস্য তাদেরকেই সময়ে সময়ে এই জটিল প্রসঙ্গে কিছু লিখতে দেখি। প্রসঙ্গের ব্যাপ্তির কারণে সবসময় ওগুলো কঠিন ও স্বভাবতই ভাসাভাসাভাবে কিছু লিখতে আমরা দেখি। ব্লগসহ অন্যান্য মিডিয়ায় যখনই ওগুলো পড়েছি - অপ্রতুল তথ্য, অপ্রতুল ধারণা-জনিত সমস্যা বিশেষত গ্লোবাল পরিসরে প্রতিষ্ঠান দুটোর উপস্হিতি, তৎপরতা ও এর তাৎপর্য নিয়ে নূন্যতম প্রাথমিক ধারণার অভাব-জনিত সমস্যা টের পেয়ে খুবই অস্বস্তি বোধ করেছি। বারবারই তখন মনে হয়েছে বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ প্রসঙ্গটা যতই বিশাল, জটিল ও নিরস হোক একে লেখার প্রসঙ্গ করা উচিত।
কিন্তু ব্লগ মিডিয়ায় কত বড় আর লেখা যায়। এছাড়া পাঠক। সাধারণ পাঠকের জন্য সহজ ভাষায় কিন্তু স্পষ্ট করে জটিল বিষয়টা তুলে ধরতে হবে। সেদিকটাও আছে।
এছাড়াও সমস্যা অনেক। এর মধ্যে আরও বড় একটা হলো, কোথায় দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠান দুটোকে দেখব ও লিখা শুরু করব। মনে হয়েছে, যেখানেই দাঁড়াই, দেখি লিখি, একটা সামগ্রিক চিত্র অবশ্যই দরকার। পাঠক যেন সেটা ভিজুয়ালাইজ করতে পারে - তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এর কতদূর পূরণ করতে পারব জানি না। তবে আপনাদের আগ্রহ সহযোগিতা অংশগ্রহণ এ পথে আমার সহায় হবে - এটা আমি নিশ্চিত।

আমাদের দুনিয়া আজ কেন, কী আকার নিচ্ছে ও আগামিতে নিবে তার জন্য ভাবনা চিন্তা, নীতিনির্ধারণ নির্ধারকভাবে করার দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান কর্তা নিশ্চয় অনেক আছে, আমরা অনুমান করতে পারি। এরা আবার নিজেদের মধ্যে ষাট-করে মানে যাকে বলে কনসেনসাস (consensus) ডেভলপ করে কাজ করে। বাইরে থেকে এটা ভাল দেখা যায় বা যায় না। অথবা এর কোন এক ঝলককে দেখে এই ঘটনার ব্যাপকতা ঠাহর আন্দাজ করাও মুশ্কিল। কিন্তু যেসব দৃশ্যমান প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুনিয়াব্যাপী এর প্রয়োগ (implementation) হয় এরকম প্রথম তিনটা প্রতিষ্ঠানের নাম করতে বললে এর উত্তর হবে আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, ও জাতিসংঘ। (ইদানীং WTO নামে চতুর্থটা তোলপাড় করে আসছিল। কিন্তু বিশ্বমন্দা এর গতি স্তব্দ করে রেখেছে আপাতত।)
পাঠক নাম তিনটা শুনে বহু দূরের কোন ঘটনা বলে ভাববেন না। কারণ, মনে রাখতে হবে দৃশ্যমান গোলকজুড়া এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় অনেকের মত আমাদের মানে, বাংলাদেশের ম্যাক্রোনমিকস (macroeconomics)। এই ভারী শব্দটা আমার না; বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ এর ফরমাল কেতাবি শব্দ। ধারণাটা হলো এরকম: গোলকজুড়া একসুতায়-গাঁথা অর্থনীতির (Global Economics) বাংলাদেশ অংশ হলো এর ম্যাক্রোনমিকস। ধারণাটাতে মনে হতে পারে একে আমাদের ঘরের (Domestic Economy) বা স্হানীয় (local) অর্থনীতি জাতীয় কিছু একটা বললেই তো হত। হয়ত বুঝতে কিছু সুবিধাও হত তাতে। কিন্তু এর অসুবিধা হল, ম্যাক্রোনমিকসের কোন কিছুই ঘরের (Domestic) বা স্হানীয় (local) ভাবে নির্ধারিত নয়, হয় না; আমরা ঠিক করি নাই। বড়জোড় কারও নির্ধারণে উপাদান হয়ে আছি, নির্ধারক নই। কাজেই নির্ধারণ ক্ষমতার ধারণা বাদে, এই বিশেষণ লাগিয়ে ঘরের (Domestic) বা স্হানীয় (local) অর্থনীতি বলার কোন মানে হয় না, এখানেই Domestic বা local শব্দদুটো অকেজো; কোন কাজে লাগে না বরং ধারণা বিভ্রাট ঘটাতে পারে। তাই Global Economics এর বাংলাদেশ অংশ বা বাংলাদেশের ম্যাক্রোনমিকস -এভাবে বুঝা ছাড়া পথ দেখি না। আপাতত এটা এখানেই থাক, এর সহজ একটা বাংলা নিশ্চয় হতে পারে। তবে এখানে এখন ধারণাটাই গুরুত্ত্বপূর্ণ। একইভাবে মনে হতে পারে, 'জাতীয় অর্থনীতি' ধরণের কিছু একটা ধারণা দিয়ে কাজ চলে কী না? না চলে না। 'জাতীয় অর্থনীতি' কথাটাও অর্থ হারিয়েছে; দাঁত পড়ে গেছে, বৃদ্ধ। জাতীয়ভাবে অর্থনীতির কোন কিছুই আর নির্ধারিত হয় না। করি না বা করতে পারি না। তবে হিসাব-কিতাব রাখার অর্থে, দরকারে জাতীয় আয়, ব্যয়, বাজেট, ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট - এসবের পরিসরে 'জাতীয় অর্থনীতি' কথাটার একটা মানে এখনও হয়।

প্রসঙ্গের অনুসঙ্গ হিসাবে একটা কথা এসে উঁকি দিচ্ছে; জাতীয় (National), Domestic বা local অর্থনীতি - এসব শব্দগুলো যদি অর্থহীন হয়ে গিয়ে থাকে তবে জাতি-রাষ্ট্র (Nation-State) বা সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র (Sovereign Nation-State) ধারণার হাল কী? রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ত্ব - বলে কোন ধারণার অবশিষ্ট আছে কী? প্রসঙ্গচ্যুতির ভয়ে এখন উত্তরে যাব না, পরে আসব। কেবল টীকামূলক একটা কথা বলে প্রসঙ্গে ফিরব। কথাটা হল, একটা সাবধানবাণী; উপরে আলোচনায় আমি ইকোনমিকস নিয়ে কথা বলছি ভাবলে ভুল হবে। তবে অর্থনীতির দিক থেকে রাজনৈতিক প্রসঙ্গে বলা কথা - এভাবে পড়লে আমার লেখার প্রতি সুবিচার হবে বলে আমার ধারণা।
যে প্রসঙ্গে ছিলাম; পাঠককে আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, ও জাতিসংঘ নাম তিনটা শুনে বহু দূরের কোন ঘটনা বলে ভাবতে না করে ছিলাম; এরপর "বাংলাদেশের ম্যাক্রোনমিকস" ধারণা পর্যন্ত এসেছিলাম। তবু এখনও "ম্যাক্রোনমিকস জাতীয় পর্যায়ের ঘটনা" - ব্যক্তির নয় বলে পাঠকের এখনও দূরেরই মনে হতে পারে। কিন্তু কথা সত্যি নয়। আসলে এই প্রতিষ্ঠান তিনটার ভুমিকা, প্রভাব (বিশেষত বিশ্বব্যাঙ্কেরটা স্পষ্ট দৃশ্যমান) আরও নীচে - আমাদের একদম রুট লেবেল পর্যন্ত। যতদূর ভাবা যায় এমন প্রত্যন্ত মফস্বলে। যেমন দেখুন - কী ধরণের ও পরিমাণে ঋণ বা আদৌও ঋণ বলে কোন তৎপরতা সেখানে থাকবে কী না; কী ধরণের হাসপাতাল না স্বাস্হ্যসেবা সেখানে পাওয়া যাবে, সবুজ ছাতা মার্কা 'ক্লিনিক' হবে না স্বাস্হ্যের নামে কেবল লাইগেশনের একটা ছাপড়া হবে, সেবা পাই না পাই ওখানে কিছু পয়সা দেয়া লাগবে না উল্টা লাইগেশনের পয়সা দিবে; বয়স্কভাতা, মুক্তিযোদ্ধা-ভাতা বলে যতকিঞ্চিত (মাসে এক-দেড়শ টাকা) কোন দানের বিলিব্যবস্হা থাকবে না কাজের বিনিময়ে খাদ্য, গম না নগদ টাকাপয়সা বিলাবে - এইসব আমাদের মফস্বলের চিত্র, সামাজিক-অর্থনৈতিক তৎপরতা। অথচ জনজীবনের এসব কিছুই আসলে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রজেক্ট অথবা প্রোগ্রাম, প্রত্যন্ত মফস্বল পর্যন্ত বিস্তৃত তৎপরতা। আবার অন্যদিকে, শহরেও প্রতিষ্ঠান তিনটির ভুমিকা ও প্রভাব সর্বত্র। যেমন অকস্মাৎ রপ্তানীমূখী নারীমেশিন জাগবে না পাটকল থাকবে বা বন্ধ হয়ে যাবে, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ইউনিট পুরনো ২১ জেলার মহুকুমা হিসাবে বহাল থাকবে না ৬৪ জেলা ও তস্য উপজেলা হবে, আবার রাষ্ট্রের এই প্রশাসনিক সংস্কার নির্বাচিত সরকার না সামরিক সরকার কায়েম করে বাস্তবায়ন করা হবে, পুরনো পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থাকবে না পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে ইআরডি বিভাগ খুলে প্রতিবছর প্যারিস ক্লাবে যাব অথবা দেশেই এপ্রিল ডোনার মিটিং এর আয়োজন করবে, কী ধরণের ব্যবসা করা যাবে - অকস্মাৎ মোজাফফর আহমেদ আইবিএ খুলে বসবেন না ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে ম্যানেজার বা এমবিএ বের হয়ে ওগুলো সামলাবে, সামরিক বাহিনী শান্তি মিশনে গিয়ে সার্ভিস দিয়ে টাকা আয় করবে না, দেশেই ক্ষমতা দখল করে সার্ভিসও দিবে টাকাও কামাবে; - এভাবে সর্বত্র। এমন কী যমুনা ব্রিজে ফাটল দেখা দিয়েছে তা নিয়ে কী করা তা জানতেও বিশ্বব্যাঙ্কের নজর আছে। বিশেষজ্ঞ নিয়োগের কোটি খানেক টাকার বন্দোবস্তের একটা প্রজেক্ট আছে সেখানে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে Global Economics বা এর বাংলাদেশ অংশ বাংলাদেশের ম্যাক্রোনমিকস বলে যেটাকে অনেক দূরের মনে হচ্ছিল সেটা আসলে দূরে তো নয়ই বরং বলা যায় আমাদের সবার মধ্যে বা আমাদের জীবনযাপন ওর মধ্যে, আমাদের লাইফ-ষ্টাইলের মধ্যে বিশ্বব্যাঙ্ক জীবিত - প্রত্যন্ত মফস্বল থেকে শুরু করে রাজধানী শহর নির্বিশেষে সবখানে বিস্তৃত। উপরে সংক্ষেপে একএক লাইনে যা উদাহরণে বলেছি, সবখানেই তা এক একটা "উন্নয়ন" প্রজেক্ট হয়ে বিরাজ করছে। এমন কী পুরো বাংলাদেশের রাষ্ট্র চালানোটাও একটা প্রজেক্ট। বিচার বিভাগের তথাকথিত সেপারেশনও একটা প্রজেক্ট। সর্বশেষ ১/১১ এর জরুরী সরকার নাজিল করাও ছিল ওদের কেতাব-খাতাপত্রে একটা "উন্নয়ন" প্রজেক্ট। এটা বিশ্বব্যাঙ্কের Corrupt Mitigation Strategies এর অধীনে একটা প্রজেক্ট। তবে এর বাস্তবায়ন ADB এর Governance and Anticorruption Policy হিসাবে - বাংলাদেশে ADB এর Good Governance প্রোগ্রাম। হাসান মসউদের দূর্নীতি দমন অভিযানও (ACC) ছিল এর প্রজেক্টের একটা অংশ। বিশ্বব্যাঙ্কের যেকোন প্রজেক্টের অনুসঙ্গ যেমন ফেজ-ওয়াইজ বা একটা বাৎসরিক রিপোর্ট দিতে হয় হাসান মসউদকেও ঠিক তাই করতে হয়েছে। রিপোর্ট জমা দিয়ে নতুন ফেজের টাকা ছাড় করে পেতে হয়েছে। সরকার চালানো নয়, বীরবিক্রমে আবার প্রজেক্টের পরের ফেজ বাস্তবায়নে লেগে পড়তে হয়েছে তাকে। অক্টোবর ২০০৮ এর তৃতীয় ফেজ শুরু হয়, যেটা এখনও চলছে। বিচার বিভাগকেও একটা বার্ষিক রিপোর্ট দিতে হবে, স্হায়ী এটর্নী স্টাফ সার্ভিস (পিপি ইত্যাদি) দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি শর্তের বিনিময়ে চলতি ফেজের টাকা ছাড় করা হয়েছে।
তাহলে আমাদের আবার জাতীয় নির্বাচনের মানে কী? নির্বাচিত প্রতিনিধি মানে কী? আমাদের কী প্রতিনিধিত্ত্ব করতে এই নির্বাচন? আমরাও আওয়ামী লীগ না বিএনপি, বাঙ্গালী না বাংলাদেশী নাকি মুসলিম - এসব নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করি, কেন - এসবের মানে কী? আমরা! এই আমরা মানে কারা? কেন? বিশ্বব্যাঙ্কের 'উন্নয়ন প্রজেক্ট" এর একএকজন মামুলি বেনিফিসিয়ারি ছাড়া আর কিছু কী? প্রজেক্ট ডকুমেন্টে প্রজেক্টের ন্যায্যতা হাজির করতে (সত্যি হোক মিথ্যা হোক) দেখাতে হয় এই প্রজেক্ট হলে কারা কারা এর সুবিধা, লাভ পাবে (বেনিফিসিয়ারি হবে), কাদের কতটুকু লাভ হবে - এই অর্থে বিশ্বব্যাঙ্কের চোখে আমরা একএকজন "বেনিফিসিয়ারি" বৈ আর কিছু কী? আমরা প্রত্যেকে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রজেক্টের একএকজন object মাত্র, তাই কী? ক্ষুধা তৃষ্ণায় আমরা আহার পান করি, ঘুমিয়ে বিশ্রাম নেই, কেউ চিমটি কাটলে টের পাই এরকম সংবেদে ইন্দ্রিয়শীলে গ্রাহ্য হই - object হবার মত সবগুণই আমাদের আছে। কিন্তু আমরা কী পলিটিক্যাল, কোন পলিটিক্যাল কমিউনিটি কী আমরা? পলিটিক্যাল আইডেনটিটি? যা দিয়ে ভুখন্ড বা কোন সীমার বাইরের অন্যদের চেয়ে আলাদা করে আমাদের চেনা যায়? যার জন্য একটা রাষ্ট্র দরকার? বিশ্বব্যাঙ্ক প্রজেক্টের একএকজন object মাত্র হওয়ার জন্য অবশ্য এসবের দরকার নাই। কিন্তু যদি নিজের মধ্যে একটা রাজনৈতিক সত্ত্বা অনুভব করি তবেই কেবল বিশ্বব্যাঙ্ক প্রজেক্টে বা স্রেফ কোন গ্লোবাল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একএকজন object মাত্র নই। তবেই ঐ প্রত্যেক রাজনৈতিক সত্ত্বার একটা কমিউনিটি বা জনগোষ্ঠিগত রূপের প্রকাশের ন্যায্যতা, একটা পলিটিক্যাল কমিউনিটি রাষ্ট্রে সংগঠিত হয়ে থাকার ন্যায্যতা থাকতে পারে। আপাতত সেটা নাই, দেখা যাচ্ছে না। হয়ে আছি কেবল বিশ্বব্যাঙ্ক প্রজেক্টে একএকজন object মাত্র।
দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাঙ্ক, Global Economy কোথায় আছে খুঁজতে, বুঝতে বাইরে যাবার দরকার নাই। আমাদের জীবনযাপন, জীবন প্রকাশের ধরণ, লাইফ স্টাইল এর উপস্হিতির প্রকাশ হয়ে আছে।

তাহলে আমাদের প্রত্যন্ত মফস্বল থেকে জগৎজুড়ে Global Economy হয়ে যে বিশ্বব্যাঙ্ক সবখানে বিস্তৃত হয়ে বসে আছে - এটাই এর পুরো শরীর। কিন্তু একে কীভাবে, এর কোথায় দাঁড়িয়ে একে বুঝব, ব্যাখ্যা শুরু করব?
আমার ধারণা এর পুরো শরীরের যে কোন খানে দাঁড়িয়েই কথা শুরু করা যেতে পারে। কেবল মনে রাখতে হবে মাথা থেকে অর্থাৎ Global Economy বা তারও উপরে বা বাইরে থেকে শুরু করলেও যেন পায়ের নখ পর্যন্ত দেখার খেয়াল থাকে, দেখা যায়। আবার পায়ের নখ বা প্রত্যন্ত মফস্বল কোন ঘটনা দেখে শুরু করলেও Global Economy এর পারস্পেকটিভটাও যেন ভুলে না যাই, দেখা যায়।

এখানে যে বিষয় নিয়ে কথা শুরু করতে যাচ্ছি এর প্রকাশ্য উপস্হিতিগুলোর ভিতর দিয়ে এই পর্বে একে পরিচয় করিয়ে দেবার সুযোগ নিলাম। এটাই প্রথম পর্ব।

তবে যেভাবেই দেখি, যেখান থেকে দেখি - কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের মৌলিক ধারণা একদম স্পষ্ট রাখতে হবে। যেমন, ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে পত্রিকা প্রিন্ট মিডিয়ায় বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ সম্পর্কে রিপোর্টে "বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ" শব্দটা লেখার আগে একটা বিশেষণ জুড়ে দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, "আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান" বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ...... এভাবে। এটা একেবারেই ভুল একটা ধারণা এবং একটা বড় ধরণের ভুল। বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ এর সম্পর্কে পপুলার বা পাঠক ধারণা স্বভাবতই খুবই নেতিবাচক। সত্যি সত্যিই সে তাইও। এর মানে এই নয় যে আমরা যা সত্যি নয় তা বলে আমাদের নেতি ধারণাকে পোক্ত করতে হবে।
"অর্থলগ্নী" - কথাটা অর্থ লাগানো বা টাকা খাটানো বলতে আমরা যা বুঝি তাই। টাকা খাটিয়ে মুনাফা কামানোই বা সুদী ব্যবসা এর লক্ষ্য। কিন্তু মুনাফা কামানো বা সুদের ব্যবসা বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ এর ঘোষিত বা অঘোষিত লক্ষ্য একেবারেই নয়।
অনেকভাবে এই দাবী আরও নাকচ করা যায়। তবে বিশ্বব্যাঙ্ককে "অর্থলগ্নীকারক" বা "সুদের ব্যবসায়ী" বলে দাবী নাকচ হয়ে যায় এমন ভাল প্রমাণ হলো বিশ্বব্যাঙ্ক যে ধার দেয় - এর সুদের হার কত - সে সম্পর্কে ধারণা থেকে। এর সুদের হার ১% এর নীচে, বেশীর ভাগ চুক্তিতে দেখা যায় তা ০.৭৫%। চুক্তিতে আবার, ধারের আসল পরিশোধের সময়ও থাকে বেশ লম্বা, কমপক্ষে ২০ থেকে ৩৫ বছর। পাঠকের ধারণার সুবিধার জন্য বিভিন্ন ধরণের ব্যাঙ্ক কারবারি কী সুদে কারবার করে - এখানে তার কিছু তুলনামূলক তথ্য দেই।
প্রত্যেক রাষ্ট্রের একটা কেন্দ্রীয় (বা অনেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা ষ্ট্রেট ব্যাঙ্ক বলে) ব্যাঙ্ক থাকে। আভ্যন্তরীণভাবে দেশের অর্থ ব্যবস্হাপনা, দেশের আর সব ব্যাঙ্ক, ব্যবসার অর্থ-বিষয়ক নিয়ন্ত্রণ, নিয়মকানুন, তদারকি করা আর বাইরে দেশের হয়ে আইএমএফের সাথে স্হানীয় অর্থ ব্যবস্হাপনা সমন্বয়, প্রতিনিধিত্ত্ব, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্হাপনা, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সবকিছু দেখা এর কাজ। এই কাজে মুনাফা তার হয় অবশ্যই তবে মুনাফা অবশ্যই এর পরিচালন লক্ষ্য নয়। কী করলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের মুনাফা বেশি হবে সেই ভেবে সে পরিচালিত নয়। আবার এটা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কও নয়, বাণিজ্য তার কাজও নয়। বরং বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে কোন বিশেষ প্রোগ্রামে স্বল্প সুদে সে টাকা ধার দেয়। সুদের হিসাবে তা সাধারণত ৬% এর নীচে থাকে। ধারে নেয়া অর্থ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক কমপক্ষে ১২-১৩% সুদের ব্যবসা করে।
তুলনা করে বুঝার জন্য আরও একটা তথ্য দেই। আজকের দিনে (ধরা যাক গেল দশ বছরের ট্রেন্ড) কোন বিদেশী প্রাইভেট বিনিয়োগকারী কোম্পানী যদি হিসাব করে দেখে তিন বছরের মধ্যে তার বিনিয়োগ তুলে ফেরত পাবার সম্ভাবনা নাই - তবে ঐ বিনিয়োগকে সে অনাকর্ষণীয় মনে করে। তার মানে সে আশা করে প্রতি বছর বিনিয়োগের রিটার্ণ হতে হবে ৩৩%।

অপর দিকে, বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্বব্যাঙ্ক গ্রুপের এখনকার সংক্ষিপ্ত নাম; ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে এমন পাঁচটা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক গ্রুপ গঠিত। এই পাঁচটার মধ্যে যার তৎপরতা সবচেয়ে ব্যাপক, সবচেয়ে প্রাচীন এর নাম হলো IBRD (International Bank Reconstruction & Development)। অথবা The Bank ও বলে অনেকে। বিশ্বব্যাঙ্কের লোন বলতে আমরা যা বুঝে থাকি তা মূলত IBRD এর লোন। IBRD এর জন্ম সবার আগে, তখন বিশ্বব্যাঙ্ক বলতে এটাকেই বুঝা হত। বাকি চার সহযোগীর জন্ম পরে ধাপে ধাপে। একসাথে এখন তা বিশ্বব্যাঙ্ক গ্রুপ। এই IBRD এর গঠন প্রকৃতি শেয়ার হোল্ডারদের মালিকানাধীন জয়েন্ট ষ্টক কোম্পানীরই [এই প্রসঙ্গে আরও বিস্তারিত পরে আসব।] মতন। তবে গুরুত্ত্বপূর্ণ তফাৎ হলো, এটা কোনকালেই কোন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক নয়।
ব্যাঙ্ক কনসেপ্টের দিক থেকে অপারেশনাল কষ্ট ও বাণিজ্যিক সুদ চার্জ করার মধ্যে একটা বড় তফাৎ করা হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাঙ্ক বা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের যেটা ০-৬% এর মধ্যে সুদ চার্জ করে, এটা অপারেশনাল কষ্ট গোত্রের। বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সুদ যেটা কোথাও ১৩% নীচে নয় (গ্রামীণ বা সমগোত্রীয়দের ক্ষেত্রে যা ২২-৩৫%) এটাই অর্থলগ্নী ব্যবসা, সুদী ব্যবসায়ের কারবার।
তাহলে ১% এর নীচে সুদে ধার দিয়ে কেন বিশ্বব্যাঙ্ক বা IBRD কাজ করে? কেন এই তৎপরতা? মুনাফা কামানো বা সুদের ব্যবসা বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ এর ঘোষিত বা অঘোষিত লক্ষ্য একেবারেই যদি না হয় তবে এর আসল লক্ষ্য কী? - এর উত্তর আমাদের জানতে হবে। পরের পর্বগুলোতে জানব।


বিভিন্ন আরও কিছু তথ্য ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে তথ্যের ভারে আটকা পরে গিয়েছিলাম। দেরির জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এই পর্ব কোন দিক থেকে শুরু করব তা নিয়ে একটা দোটানাও কাজ করছিল। আগের ঘোষণা মতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্ক জন্মানোর পশ্চাদ-পটভুমি নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব শুরু করার কথা। কিন্তু পশ্চাদ পটভুমির span বা ওসার-বিস্তার কি হবে, কত পিছন থেকে টেনে কথা শুরু করব - এটা ছিল একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত; বেশি বিস্তারে গেলে প্রসঙ্গ খেই হারিয়ে ফেলবে জানি। আবার, বিস্তার বেশি না হলে কথা অস্পষ্ট থেকে যাবে। কাজেই এই দুইয়ের একটা ভারসাম্য ঠিক করতে বেশ সময় গিয়েছে। এই পর্ব অনেক বড়, এক পোষ্টে আটানো যায় নাই। ফলে প্রসঙ্গ পরের পোষ্টেও জারি রাখতে হয়েছে, চলবে। তবে পরের কনটিনিউ পোষ্ট, তৃতীয় পর্ব বলে প্রকাশ করব।]

International Monetary Fund (IMF) বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের জন্ম ১৯৪৪ সালের ১-২২ জুলাই আমেরিকার নিউ হ্যাম্পসায়ারের ব্রেটন উড শহরের মাউন্ট ওয়াশিংটন হোটেলে; ২২ দিন ব্যাপী জারি এক কনফারেন্সের ফলাফলের মধ্য দিয়ে। এই কনফারেন্সের আয়োজক উদ্যোক্তা সংগঠন জাতিসংঘ অর্থাৎ যার নামে এই সভা ডাকা হয়েছিল। সভার নামটা ছিল এরকম: United Nations Monetary and Financial Conference at Bretton Woods - এটা তাই Bretton Woods Conference নামেও খ্যাত। ঐ একই সভা থেকে একই সাথে, আরও অনুষঙ্গ করণীয় হিসাবে, IBRD (International Bank for Reconstruction and Development) বা সংক্ষেপে World Bank এর জন্ম হয়।
জাতিসংঘের নামে আয়োজনটা আহ্বান হয়েছিল ঠিকই যখন জাতিসংঘ নিজেই সবেমাত্র জন্ম নেয়া শিশুও নয়, বরং এর হাতপা, আকার কেমন হবে সেই কথাবার্তার ফরমেটিভ স্তরে সে ছিল; তবে এই সন্তান যে গর্ভাবস্হায় এসে গেছে, আছে এমন একটা ঘোষণা (Declaration by United Nations, ১৯৪২) ইতোমধ্যে জারি হয়ে গিয়েছিল। জন্ম নিলে কারা সদস্য হয়ে জাতিসংঘ গঠনের লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করবে, সেধরণের সভা তখনও ডাকা হয় নাই। কারণ, আলোচ্য জাতিসংঘের সদস্যপদ, ভোটিং রাইট - যেটা পরে পাঁচদেশের বিশেষ ভেটো ক্ষমতা দিয়ে সমাধান টানা হয় - এগুলো নিয়ে আলোচনা তখন নিগোশিয়েশনের পর্যায়ে ছিল। সেই স্বাক্ষর-সভা ডাকা হয় আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের জন্মের আরও দশ মাস পরে, ৫০ দেশের প্রতিনিধি নিয়ে ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল আমেরিকার সান ফ্রান্সসিকোতে।
তাহলে কথা দাড়ালো এরকম: জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিক আইনী সংগঠন হিসাবে ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল জন্ম লাভের আগেই কেবল Declaration by United Nations, ১৯৪২ এর উপর ভরসা করে জাতিসংঘের নামে Bretton Woods Conference ডেকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্কের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৪ সালের জুলাইয়ে। জাতিসংঘের অধীনেই আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান দুটো কাজ করবে - শুরুতে ভাবনা এমনটাই কাজ করেছিল, তাই। কিন্তু পরবর্তিতে আভ্যন্তরীণ পরিচালনার নিয়ম কানুন বিধি তৈরির দুই বছরে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্ক বেকে বসে। ব্যাঙ্ক, টাকার কারবারি, টাকার মার্কেটে (capital market) নিজস্ব আস্হা বিষ্তারের বিষয় আছে - ফলে নিজস্ব সিদ্ধান্তই শেষ কথা এর উপর কেউ নাই - এই যুক্তিতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্ক জাতিসংঘের সাথে সম্পর্ক আলগা করে ফেলে। বিস্তর ঝগড়াঝাটির পর শেষে একটা রফা হয়। বিশ্বব্যাঙ্কের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট John Jay McCloy এর আমলে (১৯৪৭-৪৯) ও উদ্যোগে, ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ঘোষণা করা হয় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্ক জাতিসংঘের specialized agency তবে, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব বোর্ড অফ গভর্নরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যপ্তকাল ১৯৩৯-৪৫, পরিসমাপ্ত হয় ১৯৪৫ সালের আগষ্টে। ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি থেকেই একদিকে যেমন পরিস্কার হচ্ছিল হিটলার ও তার অক্ষশক্তি (জর্মানী, ইটালি ও জাপান) হারছে, হারবে ফলে অন্যদিকে আগামি যুদ্ধোত্তর দুনিয়া বিশেষত ইউরোপের চেহারা আকার কেমন হবে, বিজয়ী মুল ক্ষমতাবানেরা কে কেমন দুনিয়া-ইউরোপ দেখতে চায়, কেমন দেখতে হলে পরস্পরের স্বার্থ, কনসার্ন, উদ্বেগগুলোর সমাধা হতে পারে, পরস্পরকে কোনখানে কতটুকু জায়গা করে দিতে পারে - এসব নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাকলিন রুজভেল্ট, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ষ্টালিন ও বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের নেতৃত্ত্বে যুদ্ধের সম্ভাব্য বিজিত শক্তিত্রয় লম্বা সময় ধরে বিস্তর আলোচনা, নিগোশিয়েশনের মুলামুলি চালিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৪৪ সাল থেকে এই নিগোশিয়েশন তুঙ্গে উঠলেও মোটামুটি ভাবে ১৯৪১ -১৯৪৫ সাল - এই সময়কাল ছিল আজকের পৃথিবীকে আমরা যেমন দেখছি তার নির্ধারক ঘটনাগুলো ভ্রুণ আকার লাভের সময়। প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতিসংঘ, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্কের তাই একই আলোচনা নিগোশিয়েশনের সমবৈশিষ্টীয়, সমকালীয় ফলাফল। আবার প্রাতিষ্ঠানিক কাজকারবার শুরুও করে প্রায় একই সময় থেকে। যুদ্ধোত্তর দুনিয়ার রাজনৈতিক দিক মিটমাটের প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতিসংঘ আর অর্থনৈতিক দিক মিটমাটের বিষয় যেমন, মুখ থুবড়ে পড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, যুদ্ধের রসদ হিসাবে ইউরোপকে আমেরিকানদের দেয়া দেনা পরিশোধের উপায়,ইউরোপকে নতুন ঋণ ও যুদ্ধোত্তর পুণর্গঠন ইত্যাদি - সামলানোর জন্য আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্ক - এভাবে একই বৃন্তের তিন ফুল জাতিসংঘ, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাঙ্কের আবির্ভাব। তিনটা আলাদা প্রতিষ্ঠান হিসাবে হাজির হলেও একই উদ্দেশ্যে গাথা বেনুনীর মত (interwoven) এরা সম্পর্কিত।

উদ্দেশ্যের এই গাথা বেনুনীর আসল কনসার্ন আবার একটাই, একটা "collective security" খুঁজছিল সকলে। এটা হয়ত বুঝা সহজ প্রত্যেক রাষ্ট্র নিজের security এর জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে ছিল, কিন্তু কেন, কার বিরুদ্ধে security, নিরাপত্তা? এই প্রশ্ন্বের উত্তর সহজ নয়। সাদা চোখে অনেকের মনে হতে পারে এটা ত্রি-রাষ্ট্র-শত্রুঅক্ষশক্তি - জার্মান, ইটালি ও জাপানের - বিরুদ্ধে পশ্চিমের সকলের। আমরা অনেকে এভাবেই ইতিহাস বুঝে এসেছি। কিন্তু এই ত্রি-রাষ্ট্র কী বাকীদের সবসময়ের শত্রু? ছিল বা আছে? ঐ তিন রাষ্ট্র ও তার গঠন, কাঠামোই কী সব সমস্যার মূলে?
না! ইতিহাস তা বলে না। কাছেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) ঘটনাবলিতে যদি দেখি - ইটালি ও জাপান প্রত্যেকেরই অবস্হান তখন জার্মানের বিরুদ্ধে বিজয়ীদের দলে। বৃটিশ ও ফ্রান্স পরস্পরের সাথে অনেক যুদ্ধ লড়েছে। কাজেই ঐ তিন বা কিছু দেশকে শত্রু চিহ্নিত করে পৃথিবীর শান্তি অন্বেষণের বয়ানের গালগল্পটা সুবিধার না, ধোপে টিকে না। কাজেও আসে না। এছাড়া, বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নাই, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে পৃথিবীর শান্তি কথা বলছে, "collective security" খোঁজ করছে - প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাসের পিছনের ৩০০ বছরে, কলোনীর যুগে কী তাদের যুদ্ধ ও পরদেশ দখল করেই কাটেনি, সমৃদ্ধ হয়নি? যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিষ এমন একটা ধারণা তখন ছিল না, এখন দাঁড় করাতে চাইছে কেন? কিসের ভিত্তিতে, নতুন কোন নৈতিকতার ভিত্তিতে? কলোনী দখল পাল্টাদখলের যুগের নিজেদের মধ্যে এই তিনশ বছরে যুদ্ধই কী তাদের সমৃদ্ধির একমাত্র হাতিয়ার ছিল না?
কাজেই কিছু দেশকে শত্রু চিহ্নিত করে পৃথিবীর শান্তি অন্বেষণের বয়ান গালগল্প দিয়ে আমরা ইতিহাস বুঝতে পারব না, ব্যাখ্যা পাব না - এটা পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে। কার বিরুদ্ধে "collective security" তা জানতে আমাদের অন্য কোথাও খুঁজতে হবে, শান্তির গালগপ্পে বুঁধ হলে চলবে না।
সেখানে যাবার আগে জাতিসংঘের প্রসঙ্গ যেটুক উঁকি দিয়ে ফেলেছি তার একটা আপাত হাল করে নেই। বিস্তারে যেতে এখন পারব না, তবু যেটুকু পারি শিরোনামে বলব।

জাতিসংঘ বলে কিছু একটা যে হবে ঘোষণা আকারে তা প্রথম আসে ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি; ২৬টা জাতিরাষ্ট্রের এক যৌথ ঘোষণা(Declaration by United Nations, ১৯৪২) ছিল সেটা। এই ২৬ রাষ্ট্রের এককাট্টা হবার কারণ - এরা সবাই ত্রি-রাষ্ট্র-অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে স্ব স্ব দেশে নানান মাত্রায় যুদ্ধে রত ছিল, যেন অপেক্ষায় ছিল একটা জোট, ত্রাতা, মাতব্বরের; একটা টার্নিং পয়েন্ট বা ট্রিগার পয়েন্টর দরকার ছিল। ০৭ ডিসেম্বর ১৯৪১, আমেরিকার নিজের বুকে পার্ল হারবারে জাপানী বোমা আক্রমণ ছিল সেই ট্রিগার পয়েন্ট। জাতিসংঘ ঘোষণার মাত্র ২৪ দিন আগের ঘটনা এটা। বোমা আক্রমণের ফলে জাপান-আমেরিকার পরস্পরের বিরুদ্ধে , আমেরিকার বিরুদ্ধে জার্মানের হিটলারেরও যুদ্ধ ঘোষণা হয় এতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রথম দুই বছর নিরপেক্ষতার ভান করে আমেরিকার সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেই ইউরোপ বিশেষত বৃটিশদেরকে সহায়তা করে গিয়েছিল - এবার তার সরাসরি অংশগ্রহণ, শুরু। হামলার দিনকয়েকের মধ্যে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনষ্টন চার্চিলের আমেরিকা সফর - এসবের ফলাফলে এই যৌথ ঘোষণা। ঘোষণাটার নীট মানে ও উদ্দেশ্য হলো, জোট পাকানো; কে কে এই যুদ্ধে ত্রি-রাষ্ট্র-অক্ষশক্তিকে শত্রু মানছে তাদের জয়লাভের লক্ষ্যে এক প্রতিজ্ঞাপত্র। প্রতিজ্ঞার পয়েন্ট মাত্র দুইটা: ১. স্বাক্ষরকারী সকলে নিজ নিজ সম্ভাব্য সমস্ত রিসোর্স কাজে লাগিয়ে এক জোটে যুদ্ধে নামবে। ২. কেউ আলাদা আলাদাভাবে শত্রুর সাথে অস্ত্রবিরতি বা শান্তি চুক্তি (separate armistice or peace with the enemies) করবে না।
তবে এই প্রতিজ্ঞাপত্র শুরু হচ্ছে এক তাৎপর্যপূর্ণ বাক্য দিয়ে। মাস কয়েক আগে, আমেরিকার নি্উফাউন্ডল্যান্ড উপকুলের এক জাহাজে বসে ১৪ আগষ্ট ১৯৪১ সালে চার্চিল ও রুজভেল্টের আলোচনা উভয়ের যৌথ ঘোষণা হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। Atlantic Charter নামে এর খ্যাতি আছে। জাতিসংঘ ঘোষণা বা ২৬ দেশের প্রতিজ্ঞাপত্র Atlantic Charter এর ঘোষণাকে রেফারেন্স দিয়ে নিজ ঘোষণার অঙ্গ বলে মেনে (Having subscribed) নিচ্ছে। বলছে Atlantic Charter এ উদ্দেশ্য ও নীতির কথা যা বলা আছে আমরা তা মেনেই Declaration by United Nations ১৯৪২ ঘোষণায় স্বাক্ষর করছি; "to a common program of purposes and principles embodied in the Joint Declaration of the President of the United States of America and the Prime Minister of the United Kingdom of Great Britain" ।
আসলে Declaration by United Nations, ১৯৪২ কে যদি যুদ্ধের খরচ খরচা রসদ সংস্হানের বিপদে পড়া ২৬ দেশের আমেরিকাকে দেয়া প্রতিজ্ঞাপত্রে আকুতি জানানো বলি তবে Atlantic Charter ১৯৪১ হলো একইভাবে যুদ্ধের খরচ খরচা রসদ সংস্হানের বিপদে পড়া বৃটিশদের আমেরিকাকে দেয়া প্রতিজ্ঞাপত্র ও আকুতি। শান্তির নামে (peace-loving) পরদেশ দখল অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক বয়ান (threaten, aggression outside of their frontiers) এর কথা বলে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মন জয়ের এক চেষ্টা। কারণ, "collective security" বা সম্ভাব্য জাতিসংঘ ধারণার পক্ষে কথা বললেই একমাত্র তাঁর মনজয় সম্ভব। তবেই তিনি প্রত্যক্ষে হিটলারের বিরুদ্ধে বৃটিশের পক্ষে দাড়াবেন। রুজভেল্টের চিন্তা যুদ্ধ পরবর্তী দুনিয়ায় বিশ্বক্ষমতা শক্তির ভারসাম্য নিয়ে, কি চেহারায় একে আঁকতে চান সেটা নিয়ে। Atlantic Charter ১৯৪১ এর পূর্ণ মূল বয়ান নিয়ে একটা আলোচনা এক্ষেত্রে ইনটারেসটিং হতে পারে। মনে রাখতে হবে, চার্চিল যখন Atlantic Charter ১৯৪১ পরদেশ দখল অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক বয়ান ফতোয়া দিচ্ছে যার ভিত্তিতে 'শান্তির' একটা জাতিসংঘ হয় হয় করছে তখনও কিন্তু আমরা তাঁর কলোনীগ্রস্হ, ভারতবর্ষ মানে বৃটিশ ইন্ডিয়া। বৃটিশ কলোনীপ্রভু শার্দুলের এই উল্টা বয়ানে মিউ মিউ আওয়াজ সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ।

যদিও আমরা গদগদ হয়ে "শান্তির" নতুন হদিস আনার প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতিসংঘকে দেখি। জাতিসংঘের জন্মের ইতিহাস ব্যকগ্রাউন্ড বলতে গিয়ে Atlantic Charter, Declaration by United Nations (আরও একটা আছে Yalta Agreements, February 11, 1945) - এসবের কথা সম্ভ্রম সম্মানের সাথে বলতে দেখি। কিন্তু আমরা যদি সাহসের সাথে এই চুক্তিগুলোকে নির্মোহ পর্যালোচনা করতে বসি তাহলে বুঝতে পারব - দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এমন কী ঘটনা ঘটেছিল যাতে ৩০০ বছরের কলোনী লুট করে আনা সম্পদ ইউরোপের কলোনী ওস্তাদদের থেকে হস্তান্তর হয়ে আমেরিকাকে এক নম্বর বিশ্বশক্তির ভুমিকায় বসিয়ে দিল। পরদেশ দখল অন্যায় - এই নৈতিকতার চ্যাম্পিয়ান চার্চিলের Atlantic Charter, বিশ্বশান্তি আজ কোথায়? নাকি বিশ্ব আজ আরও বেশি করে অশান্ত? জাতিসংঘ কী "collective security" নিশ্চিত করতে পেরেছে? না কী ২০০৩ সালে বুশ ইরাকে হামলার প্রসঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতি আদায় করতে না পেরে জাতিসংঘকেই ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দিয়েছে? অবশেষে সম্মতি ছাড়াই নিজ উদ্যোগে বুশ-ব্লেয়ার ইরাকে হামলা করেছে?
তাহলে "collective security" এর অর্থ কোথায় খুঁজব? কী ব্যাখ্যা তার। এনিয়ে আগামি পর্বে দেখা হবে। এছাড়া IMF প্রসঙ্গে ফিরতে হবে।

0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]

<< Home