চোখ,
বস্তু থেকে সমান্তরাল আলোক রশ্মি চোখের কর্ণিয়া বা কালো রাজার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় বেঁকে যায় এবং চোখের লেন্সের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় দ্বিতীয় বার বেঁকে চোখের রেটিনায় বস্তুর প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে বিধায় আমরা ওই বস্তুটি দেখতে পাই। আলোক রশ্মির এই পথ যদি স্বাভাবিক থাকে, তাহলে যে কোন গঠনগত পরিবর্তন বা কোন রোগ যদি না থাকে সে ক্ষেত্রে চশমা দিয়ে সে দৃষ্টির উন্নয়ন সম্ভব। তখন সেটাকে রিফ্রাকটিভ ইয়ব বা পাওয়ার জনিত দৃষ্টি স্বল্পতা বলা হয়। এটি সাধারণত চার ধরনের হয় মায়োপিয়া (ক্ষীণদৃষ্টি), হাইপারোপিয়া (দূরদৃষ্টি), প্রেসবায়োপিয়া বা চালশে এবং অ্যাসটিগমেটিজম।
মায়োপিয়াঃ এ ধরনের রোগীরা কাছে মোটামুটি ভাল দেখতে পারলেও দূরে ঝাপসা দেখে, তাই এদের ঋীণদৃষ্টি বলা হয়। অবতল লেন্স বা মাইনাস পাওয়ারের চশমা পড়লে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। যাদের চোখে ছয় ডায়াপটারের বেশী মাইনাস পাওয়ারের লেন্স লাগে এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে চোখের পাওয়ার ও বাড়তে থাকে তখন তাকে প্যাথলজিকাল মায়োপিয়া বলা হয়। সেক্ষেত্রে চোখের দেয়াল বা স্ক্লেরা পাতলা হয়ে যায় এবং রেটিনাতে ছিদ্র সৃষ্টি হয়ে পরবর্তীতে রেটিনা আলাদা হয়ে গিয়ে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। মায়োপিয়াতে চোখের আকার বড় হওয়া কারণে চোখের দেয়াল পাতলা হয়ে যায়। সেজন্য সামান্য আঘাতেই চোখে অনেক মারত্বক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং মায়োপিয়া রোগীদের সবসময় চোখের আঘাত থেকে সাবধান থাকতে হবে এবং নিয়মিতভাবে ডাক্তারের পরামর্শে চোখের পাওয়ার পরীক্ষা এবং রেটিনার পরীক্ষা করিয়ে নেয়া ভাল।
হাইপারোপিয়াঃ এ ধরনের রোগীরা দূরে এবং কাছের উভয় দিকেই ঝাপসা দেখে এবং অফিসিয়াল কাজ করার সময় রোগীর চোখের উপর চাপ পড়ার কারণে মাথা ব্যাথার অনুভূতি হয়। স্বাভাবিক চোখের চেয়ে একটু ছোট থাকে, যদিও ওটা বোঝা যায়না। উত্তল বা প্লাস লেন্সের চশমা ব্যবহার করে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
অ্যাসটিগ ম্যাটিসমঃ এটি এক ধরনের দৃষ্টি স্বল্পতা, যাতে রুগীর কর্ণিয়ার সে কোন একদিকে (লম্বদিকে, প্রস্থে অথবা কোণাকোনি) পাওয়ার পরিবর্তন হয় বলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। এর কারণে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, একটি জিনিসকে দুইটি দেখা এবং মাথা ব্যাথা হতে পারে। সিলিন্ডার লেন্স ব্যবহারে এ সমস্যার সমাধান হয়।
প্রেসবায়োপিয়াঃ এতে বয়সজনিত চোখের গঠনগত পরিবর্তনের কারণে চোখের লেন্সের ইলাসটিসিটি বা স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস পায়, ফলে লেন্সের প্রয়োজনে (বিশেষ করে কাছের জিনিস দেখার জন্য) আকার পরিবর্তন করার ক্ষমতা কমে যায় এবং কাছের জিনিস ঝাপসা দেখায়। চল্লিশ বছরের পর এ সমস্যা দেখা যায় বলে একে চালসে রোগ বলা হয়। শুধু কাছের জিনিস দেখার জন্য (বিশেষ করে পড়াশুনার জন্য) উত্তল বা প্লাস লেন্স ব্যবহার করলে এ সমস্যার সমাধান হয়। বয়স বড়ার সাথে সাথে চশমার পাওয়ার ও পরিবর্তন হয়।
চিকিৎসা ডাক্তারের পরামর্শে রোগের ধরণ অনুযায়ী পাওয়ার চেক করে চশমা ব্যবহার করা যেতে পারে।
চশমা যারা পড়তে চায়না, তারা কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার বিধি একটু জটিল বিধায় অনেকের পক্ষে ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনা।
বর্তমানে লেজসার সার্জারীর মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। এক্সাইমার লেজসার ব্যবহার করে চোখের পাওয়ার পরিবর্তন করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। একে ল্যাসিক রিক্সাকটিভ সার্জারী বলা হয়। এর মাধ্যমে ১২ ডায়াপটার পর্যন্ত মায়োপিয়া, ৫ ডায়াপটার পর্যন্ত অ্যাসটিকমেটিসম এবং ৪ ডায়াপটার পর্যন্ত হাইপারোপিয়ার চিকিৎসা সম্ভব। সবছেয়ে বড় সুবিধা হল, ল্যাসিক করার পর সাধারণত চশমা অথবা কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েনা।
মনে রাখতে হবে
০ বাচ্চাদের দৃষ্টি স্বল্পতার তড়িৎ চিকিৎসা প্রয়োজন, না হয় অলস চোখের কারণে দৃষ্টিশক্তি স্থায়ীভাবে কমে যেতে পারে।
০ কাছ থেকে সে সব শিশু টেলিভিশন দেখে অথবা টেলিভিশন দেখার সময় চোখ টেরা হয়ে যায় এবং চোখ থেকে পানি পড়ে, তাদের তাড়াতাড়ি চোখ পরীক্ষা করিয়ে নেয়া ভাল।
০ মাথা ব্যাথা চোখের পাওয়ার পরিবর্তনের লক্ষণ, সুতরাং মাথা ব্যাথা হলে একবার চোখ পরীক্ষা করিয়ে নেয়া ভাল।
০ ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রন না থাকলে চশমা ব্যবহার করে খুব ভাল ফল পাওয়া যায়না, কারণ এতে ঘন ঘন চোখের পাওয়ার পরিবর্তন হয়।
০ যারা নতুন নতুন চশমা ব্যবহার শুরু করবেন তাদের চশমাতে অভ্যস্ত হতে ১০-১৫ দিন সময় লেগে যায়, এ সময়ে চশমা ব্যবহার অস্বস্থি লাগলেও এটি ব্যবহার বন্ধ করা ঠিক নয়।
০ যারা কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করতে চান, তারা অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার বিধি মেনে ব্যবহার করবেন।
০ সব রুগীরা সবসময় ল্যাসিক করা সম্ভব হয়না, ডাক্তারের পরামর্শে ল্যাসিক সেন্টারে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চোখ ল্যাসিক যোগ্য হলেই একমাত্র ল্যাসিক সার্জারী করা হয়।
ডাঃ শামস মোহাম্মদ নোমান
চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
দৈনিক ইত্তেফাক, ০৫ সেপ্টেম্বের ২০০৯।
চোখ সুস্থ রাখতে রঙিন শাক সবজি ফলমূল
চোখ সুস্থ রাখতে হলে দরকার অতি প্রয়োজনীয় উপাদান ভিটামিন ‘এ’। নিত্যদিনের খাবারের তালিকায় ‘এ’ ভিটামিনযুক্ত খাবার অবশ্যই থাকা উচিত। সঠিক পরিমাণে এই ভিটামিনযুক্ত খাবার না খেলে রাতকানা রোগ এবং চোখের অন্যান্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে। ভিটামিন ‘এ’-এর প্রধান উৎস প্রাণীজ প্রোটিন যেমন যকৃত, ডিমের কুসুম, দুধ, মাখন, পনিরও মাছ। ছোট মাচ বা মলা, ডেলা, পুঁটিমাছ খেলে চোখ ভার থাকে, রাতকানা রোগ হয় না এ কথা ছোট বেলায় সকলেই শুনে থাকে। সস্তা এবং সহজলভ্য রঙিন ফলমূল শাকসবজি থেকেও প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়। এসব খাবার টাটকা এবং সহজপাচ্যও বটে। গাঢ় সবুজ পাতাযুক্ত সবজি- কচুশাক, সজিনাশাক, পালং শাক, লাউশাক, নটেশাক, পুঁইশাক, সীম, বরবটি, গাজর, মিষ্টিকুমড়া, পাকা আম, পেঁপে, তরমুজ, কাঁঠাল ইত্যাদি। এ জাতীয় খাবার যারা নিরামিষ ভোজী চোখ ভাল রাখার জন্য ছোটবেলা থেকেই সব ধরনের শাক-সবজি, ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত। অল্প সেদ্ধ বা কাঁচা সালাদা, ফল ও ফলের রসের সঙ্গে অবশ্যই দুধ, দই, ছানা খাওয়া উচিত। সয়াবিন ভিটামিন ‘এ’-এর আরেকটি ভাল উৎস। বিভিন্নভাবে সয়াবিন রান্না করে খাওয়া যায়। ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে অন্ধকারে দেখার উপযোগী চোখের রডকোষগুলোর কর্মদক্ষতা আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে। ফলে শিশু রাতের বেলায় কোন জিনিস খুঁজতে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ঘুরতে থাকে এবং কোন জিনিসে বাঁধা পেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। বাচ্চা জন্মের সময় তার শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ সঞ্চিত থাকে এবং মায়ের দুধে পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ থাকায় মাতৃদুগ্ধ পান করা পর্যন্ত এই ভিটামিনের অভাবজনিত সমস্যা হয় না। কিন্তু শিশুর যখন বাড়তি খাবার প্রয়োজন হয় তখন এই ভিটামিনের অভাব হলে চোখের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। শিশুদের চোখের যে সমস্যাগুলো বেশি দেখা যায় তা হলো বিটট স্পট। এতে অক্ষি শুষ্কতার পর চোখের বাইরের আবরণে কিছু ছোট ছোট দাগ পড়ে। ফলে কর্নিয়া অস্বচ্ছ ও ঘোলাটে দেখায় এবং কর্নিয়ার অনুভূতি কমে যেতে থাকে। এর ফলে দেখতে অসুবিধা হয়। পরে কর্নিয়াতে সংক্রমণ হয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়। তখন শুধু ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত খাবার খেলেই চলবে না নিয়মিত ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেতে দিতে হবে। বয়স্কদের ছানি পড়া বিলম্বিত করতে ভিটামিন এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সঠিকভাবে ভিটামিন এ যুক্ত খাবার নিয়মিত না খেলে নির্ধারিত সময়ের আগেই আলো ঝাপসা হয়ে যেতে পারে।
ডাঃ জ্যোৎস্না মাহবুব খান
মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ এপ্রিল ২০০৯।
বাতব্যথায় চোখের সমস্যা
বাতরোগ হল হাঁড় এবং মাংসপেশী সম্পর্কিত। এর সাথে আবার চোখের সম্পর্ক কোথায়? ভাবতেই অবাক লাগছে তাই না? শরীরের এমন অনেক রোগ আছে যাতে চোখের সমস্যাও একটা প্রধান ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
যেসব বাতরোগে চোখের সমস্যা হয়ঃ
রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস-এতে সাধারণত হাড় এবং পায়ের ছোট জয়েন্টে প্রদাহ হয়, তার সাথে চোখের শুষ্কতা, স্ক্লেরাইটিস (চোখের সাদা অংশের প্রদাহ), কেরাটাইটিস (চোখের কর্ণিয়ার প্রদাহ) ইত্যাদি হতে পারে।
জুভেনাইল আরথ্রাইটিস হাঁটু এবং পায়ের গোড়ালিসহ ছোট বড় বিভিন্ন জয়েন্টে প্রদাহ সৃষ্টিকারী এই রোগ সাধারণত ১৬ বছরের কম ছেলে-মেয়েদের বেশি হয়। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চোখে ব্যথাযুক্ত প্রদাহ বা ইউভাইটিস হতে পারে।
এনকাইলোসিং স্পনডাইলাইটিস- মাজায় ব্যথা এবং প্রদাহ সৃষ্টিকারী এই রোগে শতকরা ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে চোখের সমস্যা হতে পারে। এতে চোখে ইউভাইটিস এবং স্ক্লেরাইটিস হতে পারে।
রিটার সিনড্রম- এই রোগে হাঁটু, পায়ের গোড়ালি, পায়ের আঙ্গুল ইত্যাদি অংশ হঠাৎ করে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। সাথে সাথে চোখের কনজাংকটিভা, সাদা স্কেরা, কর্ণিয়া, ইউভিয়া, দৃষ্টি স্নায়ু এমনকি রেটিনাতেও প্রদাহ হতে পারে।
চোখের সমস্যা কিভাবে বুঝবেন?
শুষ্ক চোখ- চোখে জ্বালাপোড়া, কচকচ করা, ময়লা জমা, চোখের পানি কমে যাওয়া ইত্যাদি চোখের শুষ্কতার লক্ষণ।
কর্ণিয়া ঘা- বাতরোগের সাথে সাথে কোন কোন ক্ষেত্রে চোখের কালোরাজাতে ঘা হতে পারে। চোখে ব্যথা হওয়া, পানি পড়া, আলোতে চোখ খুলতে না পারা ইত্যাদি কর্ণিয়া ঘা-এর লক্ষণ।
স্কেরাইটিস- চোখের সাদা অংশ হঠাৎ করে লাল হওয়া, প্রচন্ড ব্যথা করা, চোখ নাড়াতে অসুবিধা হওয়া এই রোগের লক্ষণ। বাতের ব্যথার সাথে সাথে আক্রান্ত চোখেও ব্যথা শুরু হয়।
ইউভাইটিস- চোখের ভেতরে রক্তনালী পূর্ণ স্তরের প্রদাহকে ইউভাইটিস বলা হয়। বাতরোগের সাথে সবচেয়ে কমন চোখের রোগ এটি। দুই চোখে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া, চোখে লাল হওয়া, আলো সহ্য করতে না পারা ইত্যাদি এ রোগের লক্ষণ। এই রোগের কারণে কর্ণিয়ার পেছনে পূঁজ জমে এবং চোখের চাপ বেড়ে গিয়ে রোগী অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
করণীয় প্রথমত ডাক্তারের পরামর্শে বিভিন্ন পরীক্ষা যেমন রক্ত পরীক্ষা, জয়েন্ট এক্সরে করার মাধ্যমে বাতরোগের ধরন সনাক্ত করতে হবে। তারপর সেই রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে হবে। ডাক্তার সাধারণত ব্যথার ওষুধ ছাড়াও বিভিন্ন ডিজিজ মডিফাইং ওষুধ, ইমুনোসাপ্রেসর ওষুধ ইত্যাদি সেবনের পরামর্শ দেন। নিয়মিত এসব ওষুধ সেবনে রুগী অনেক আরামবোধ করেন। ডাক্তারের পরামর্শে কিছু প্রয়োজনীয় ব্যায়াম করা যেতে পারে।
বাতরোগ বাড়ার সাথে সাথে চোখে সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে চক্ষু চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। সময়মত চিকিৎসা শুরু করা না গেলে চোখের প্রদাহের কারণে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। সাধারণত একসাথে দুই চোখ, আবার একটির পর আরেকটি আক্রান্ত হতে পারে। বাতরোগের চিকিৎসার সাথে সাথে আক্রান্ত চোখের চিকিৎসা জরুরি।
এট্টোপিন আই ড্রপ কর্ণিয়ার ঘা এবং ইউভাইটিস দুইটি রোগের কার্যকরী। স্টেরইড ড্রপ-এর নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহারে চোখের প্রদাহ অনেকাংশে কমে আসে। চোখের চাপ বেড়ে গেলে ডাক্তারের পরামর্শে এন্টিগস্নুকোমা ড্রপ ব্যবহার করা যেতে পারে। চোখের প্রদাহের কারণে লেন্সে ছানি পড়তে পারে। এতে দৃষ্টি কমে যেতে পারে। আইড্রপ ব্যবহার করে চোখের প্রদাহ কমলে ছানি অপসারণ এবং কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি অনেকাংশে ফিরে পাওয়া সম্ভব। বাতরোগের চিকিৎসায় যারা অনেকদিন ধরে স্টেরইড সেবন করেন তাদের চোখে ছানি এবং গস্নুকোমা রোগ হতে পারে। সুতরাং ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতিত অনিয়ন্ত্রিত স্টেরইড সেবন করা উচিত নয়।
ডাঃ শামস মোহাম্মদ নোমান
এম,বি,বিএস, ডি,সিও, এফ,সি,পি,এস(চক্ষু)
জুনিয়র কনসালটেন্ট, চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রঃ, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম। drshams_noman@yahoo.com
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ মার্চ ২০০৯।
চোখের ঘাঃ কারণ ও প্রতিকার
এই রোগ কি?
আমাদের চোখের সামনের অংশে যে গোলাকার কালো অংশ দেখা যায়, তাকে কালো রাজা বা কর্নিয়া বলা হয়। কোন কারণে কর্নিয়ার প্রদাহ এবং পরবর্তীতে ঘা তৈরি হওয়াকে কর্নিয়াল আলসার বা কালো রাজার প্রদাহ বলা হয়।
কেন হয়?
- চোখের আঘাতজনিত কারণে এই রোগ সবচেয়ে বেশি হয়। আমাদের দেশে ধান কাটার মৌসুমে ধানের পাতার আঘাতের কারণে এই রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যায়। ত্ত অপুষ্টিজনিত কারণে বিশেষ করে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে শিশুদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যায়। ত্ত যাদের চোখের পাপড়ির গোড়ায় সব সময় অপরিষ্কার রাখার জন্য প্রদাহ বা বেস্নফারাইটিস হয়, তাদের চোখে কর্নিয়ার প্রদাহ হতে পারে। ত্ত নেত্রনালী বন্ধজনিত চোখের পানি পড়া রোগের কারণেও কালো রাজার প্রদাহ হতে পারে।
রোগের লক্ষণঃ
০ আলোতে চোখ খুলতে না পারা।
০ চোখে প্রচণ্ড ব্যথা হওয়া।
০ চোখ লাল হয়ে যাওয়া।
০ চোখ হতে পানি পড়া।
০ চোখের কালো মণিতে সাদা দাগ বা ঘা দেখা যাওয়া ইত্যাদি এই রোগের লক্ষণ।
প্রতিরোধে করণীয়ঃ
০ চোখে কিছু পড়তে পারে বা চোখে আঘাত লাগতে পারে এমন পেশায় যারা নিয়োজিত আছেন, তারা কাজ করার সময় গগলস বা চশমা ব্যবহার করতে পারেন।
- চোখে কোনকিছু পড়লে, বেশি ঘষাষষি না করে পরিষ্কার পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলা প্রয়োজন। ত্ত সর্বদা নিয়মমত চোখ পরিষ্কার রাখা বাঞ্ছনীয়। ত্ত নেত্রনালীর সমস্যার কারণে পানি পড়া রোগের চিকিৎসা করিয়ে নেয়া প্রয়োজন। ত্ত কোন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যেমন শামুকের পানি, চুনের পানি ইত্যাদি ব্যবহার হতে দূরে থাকতে হবে। এগুলো ব্যবহারের কারণে রোগ জটিলরূপ ধারণ করে। ত্ত ডাক্তারের পরামর্শে কর্নিয়াতে ঘা হওয়ার আগে ওষুধ ব্যবহার প্রয়োজন।
চিকিৎসাঃ
আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে কিছু কিছু হাতুড়ে চিকিৎসক চোখে বিভিন্ন রকম ক্ষতিকারক পদার্থ যেমন-শামুকের পানি, চুনের পানি ইত্যাদি দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা শুরু করেন।
পরিশেষে সম্পূর্ণ চোখে এই ঘা ছড়িয়ে পড়ে রোগ জটিলরূপ ধারণ করে।
- সুতরাং উপরোল্লিখিত উপসর্গ দেখা মাত্র নিকটবর্তী চক্ষু চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।
- বিভিন্ন উন্নত চক্ষু চিকিৎসা কেন্দ্রে ঘা থেকে পুঁজ নিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে সেই পুঁজে যে জীবাণু পাওয়া যায় সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধের মাধ্যমে ঘা এর চিকিৎসা করা হয়।
- মনে রাখতে হবে, স্টেরইড জাতীয় চোখের ড্রপ ব্যবহারের ফলে কর্নিয়ার ঘা জটিলরূপ নিতে পারে। সুতরাং ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এ জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করবেন না।
- ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক সময়মত ওষুধ ব্যবহারে এই রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল সম্ভব।
তবে ত্বরিৎ চিকিৎসা শুরু না হলে ঘা এর গভীরতা বেড়ে যাওয়ার কারণে চিকিৎসার পরেও কর্নিয়া বা কালো রাজাতে দাগ পড়ে যাওয়ার ফলে স্থায়ী দৃষ্টি স্বল্পতা হতে পারে।
ডাঃ শামস মোহাম্মদ নোমান
এম,বি,বিএস, ডি,সিও, এফ,সি,পি,এস(চক্ষু)
জুনিয়র কনসালটেন্ট
চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম।
drshams_noman@yahoo.com
দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ মার্চ ২০০৯।
ছানি অপারেশনঃ কৃত্রিম লেন্সের দাম ও কার্যকারিতা
হালিমা খাতুন (ছদ্মনাম) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পঞ্চাশের ওপর বয়স। এ বয়সেই তাঁর চোখে ছানি পড়েছে। ফলে ঠিকমতো কাজকর্ম করতে পারেন না। তিনি জেনেছেন ছানি রোগের ভালো চিকিৎসা হচ্ছে আজকাল। আগের মতো আর অপারেশনের পর দুই দিন সটান শুইয়ে রাখা হয় না। এরপর মাস দেড়েক পর মোটা কাচের চশমা ব্যবহার করতেও হয় না। আগে হাজার পাওয়ারের ওপরে, ওই চশমা হারিয়ে গেলে নতুন চশমা না নেওয়া অবধি অচল থাকতে হতো। আজকাল আর এসব নেই। চোখে অস্ত্রোপচার করে কৃত্রিম লেন্স সংযোজন করা হয়। ফলে রোগী অস্ত্রোপচার সম্পন্নের দিন থেকেই দেখতে শুরু করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক দিনের মতো চোখ ঢেকে রাখা হয়, পরের দিন থেকেই দৃষ্টি লাভ! কৃত্রিম লেন্স সংযোজনের দরুন পুরোপুরি দৃষ্টিপ্রাপ্তি সম্ভব। অর্থাৎ তরুণ বয়সের দৃষ্টিশক্তির মতোই দৃষ্টিশক্তি পাওয়া যায়। হালিমা খাতুন এসব জেনেই এসেছেন ছানির অপারেশন করাতে।
হালিমা খাতুন যথারীতি হাসপাতালে ভর্তি হন। অপারেশনের আগের দিন তাঁর চোখের লেন্সের পাওয়ারের মাপ নেওয়া হয়। ইতিমধ্যে তিনি জেনেছেন, চোখে যে লেন্স সংযোজন করা হয় তা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। লেন্সের প্রকারভেদে মূল্য ২০০ টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। হালিমা বাড়ি থেকে যে টাকা নিয়ে এসেছেন, তাতে ১৫ হাজার টাকার লেন্স সংযোজন সম্ভব নয়। সাধারণভাবেই তাঁর ধারণা, ১৫ হাজার টাকার লেন্স নিশ্চয়ই ২০০ টাকার লেন্সের চেয়ে অনেক ভালো।
তাঁর মনে দ্বিধা জন্মায়। একবার ভাবেন এযাত্রায় অস্ত্রোপচার না করিয়ে বাড়ি গিয়ে ধারদেনা করে টাকা নিয়ে এসে ওই ১৫ হাজার টাকার লেন্সই চোখে লাগাবেন। আবার ভাবেন, বেতনের টাকার বাইরে তেমন তো তাঁর আয় নেই! ধার করা টাকা পরিশোধ করতে বেতনের টাকায় বেশ কমাস লাগবে। কাজেই প্রয়োজন কী? তিনি তাঁর চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেন। চিকিৎসক জানান, চোখের ভেতর ঠিকমতো পৌঁছতে পারলে ১৫ হাজার টাকার লেন্স যা করবে, ২০০ টাকার লেন্স তা-ই করবে।
ওপরের ঘটনাটি থেকে বোঝা যায় যে রোগীরা আধুনিক চিকিৎসালয়ে এসে এক ধরনের বিভ্রান্তির শিকার হন। লেন্সের মূল্যের তারতম্যে এ বিভ্রান্তি আসাটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ বিদেশি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের জিনিসের প্রতি দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্রের লেন্স নিশ্চয়ই ভারতের লেন্সের চেয়ে ভালো! কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের লেন্স লাগাবেন এ ধরনের সিদ্ধান্ত অনেক সময় নিয়ে ফেলেন রোগীরা।
এ ক্ষেত্রে লেন্স সম্পর্কে রোগীদের মনে সৃষ্ট এ বিভ্রান্তি নিরসনে চিকিৎসকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকেরই দায়িত্ব হলো রোগীকে বুঝিয়ে বলা যে লেন্সের মূল্যের তারতম্য লেন্সের কার্যকারিতায় তেমন কোনো ভূমিকা পালন করে না। ২০০ টাকার ভারতীয় লেন্সের সঙ্গে দুই হাজার ২০০ টাকার যুক্তরাষ্ট্রের লেন্সের কার্যকারিতায় কোনো তফাত নেই। লেন্স সংযোজনে কোনো অসুবিধা না হলে উভয় ক্ষেত্রে সমপর্যায়ের দৃষ্টিশক্তি লাভ করা যায়। তবে লেন্স পছন্দের ক্ষেত্রে রোগীর পছন্দের স্বাধীনতা অবশ্যই থাকা দরকার।
এবার আবার হালিমা খাতুনের প্রসঙ্গে আসি। হালিমা খাতুন চিকিৎসকের মন্তব্য শুনে কিছুটা আশঙ্কামুক্ত হন। তিনি তাঁর নিয়ে আসা টাকায়ই অস্ত্রোপচারের যাবতীয় খরচ নিষ্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। এর পরও তাঁর মনে একরকম খুঁত থাকে-নিশ্চয়ই ১৫ হাজার টাকার লেন্সটা হয়তো ভালো। তাঁর পাশের শয্যার ব্যবসায়ী সন্তানের মাকে ওই লেন্স লাগানো হবে। আবার তাঁর অদূরে এক পোশাকশ্রমিকের মায়ের চোখে লাগানো হবে ২০০ টাকার লেন্স।
একই দিনে তাঁদের সবার চোখে লেন্স সংযোজন হয়। একই সার্জন তা করেন। পরের দিন অস্ত্রোপচারকৃত সব রোগীর চক্ষু পরীক্ষার কক্ষে নিয়ে আসা হয়। তালিকা দেখিয়ে রোগীদের দৃষ্টি মাপা হয়। হালিমা দেখলেন তাঁর দৃষ্টি, তাঁর পাশের ব্যবসায়ীর মায়ের দৃষ্টি ও পোশাকশ্রমিকের মায়ের দৃষ্টিতে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ ১৫ হাজার টাকা, দুই হাজার ২০০ টাকা, ২০০ টাকার লেন্সের কার্যকারিতা একই স্তরের।
এবার হালিমা খাতুনের মনে আর দ্বন্দ্ব নেই। তিনি ছুটির কাগজপত্র নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হন। সঙ্গে নিয়ে যান কৃত্রিম লেন্স সম্পর্কে এক রকম ধারণা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর পরিচিত ছানি রোগীদের এ বার্তাটাই দেবেন যে লেন্সের কার্যকারিতায় দামের পার্থক্যের তেমন কোনো ভূমিকা নেই।
মো· শফিকুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম আলো, ২২ এপ্রিল ২০০৯।
চশমা বদলাতে চাইলে
প্রয়োজন যখন ডায়াবেটিক রোগীর
‘ডায়াবেটিস’ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তের চিনির ওঠানামার সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি পরিবর্তিত হয়। তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর চশমা নেওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া জরুরি-
১• চশমা নেওয়ার আগে সুগার বা চিনির মাত্রা নির্ণয় করে নিতে হবে। রক্তে চিনির মাত্রা বেশি হলে সে মুহূর্তে চশমা বদল করা উচিত হবে না। কেননা সেই সময় থেকে চশমা-পরবর্তী সময়ে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পর তা দৃষ্টিশক্তির সঙ্গে খাপ খাবে না।
২• রক্তে চিনি নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে একদম স্বাভাবিক পর্যায়েই যে চিনির মাত্রা থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।
তবে তা ১০ মিলিমল/লিটারের নিচে হতে হবে। খালিপেট ও ভরাপেটে রক্তে চিনির মাত্রার পার্থক্য চার মিলিমল/লিটারের ভেতর থাকা ভালো।
৩• আপনার ঘরে যদি গ্লুকোমিটার থেকে থাকে তাহলে চক্ষুবিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার আগমুহূর্তে রক্তে চিনির মাত্রা জেনে নিন এবং তা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে জানান।
পরীক্ষার্থীর যখন চশমা বদলানো প্রয়োজন
চোখ ও মাথাব্যথায় আক্রান্ত হলে পরীক্ষার্থী সন্তানকে নিয়ে মা-বাবার দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছেলেমেয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কোচিং সেন্টার থেকে ফিরে এসেই মা-বাবার কাছে মাথাব্যথা উপসর্গের কথা জানায়। ‘দূরে দেখা যায় না’, ‘সামান্যক্ষণ’ পড়াশোনা করলেই মাথাব্যথা হয়, ‘মনোযোগ থাকে না’ ইত্যাদি উপসর্গের কথা বলে থাকে। এসব ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে মা-বাবা তাদের চক্ষুবিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান। দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফলপ্রসূ চিকিৎসা পাওয়া যায় না।
কী করবেন
?? কোচিং সেন্টার থেকে ফিরে আসার বা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া শেষ করার পরপরই চক্ষুবিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাবেন না। কেননা এ সময় ছেলেমেয়েদের চোখ তখন ক্লান্ত থাকে। ক্লান্ত চোখের অন্তঃস্থিত পেশি স্বাভাবিক অবস্থায় না থাকায় সে সময় চোখে এক ধরনের দৃষ্টিজনিত সমস্যা দেখা দেয়। তাই এ সময় চশমা নেওয়া হলে তা সঠিক মাত্রার হবে না। ফলে আপনার সন্তানের উপসর্গগুলো ভালো হবে না।
?? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে আপনার সন্তানের চোখের বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ দিন। প্রয়োজনে যেদিন তাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাবেন, সেদিন কোচিং সেন্টারে যাওয়া বা ঘণ্টা দুয়েকের জন্য পড়াশোনা থেকে বিরত রাখুন। প্রয়োজনে তাকে ঘুমোতে দিন।
?? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে প্রথম দিকে যাতে দেখাতে পারেন সে জন্য আগেই নাম তালিকাভুক্ত করুন। অর্থাৎ পরীক্ষার্থী নিয়ে দীর্ঘ ‘সিরিয়ালের’ পরিবর্তে প্রথম দিকেই পরামর্শ নিন। এতে আপনার সন্তানের চোখের পরীক্ষাটাও ভালো হবে।
ডা• মো• শফিকুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক প্রথম আলো, ০৭ মে ২০০৮
চোখের যত সমস্যা
প্রশ্নঃ চশমা বানাবার পর তা কি আবার চক্ষু বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা করানো উচিত?
উত্তরঃ হ্যাঁ। চশমা বানাবার পর আবারো তা পরীক্ষা করানো উচিত। চশমা আসলে একটি জটিল বিষয়। চশমা দেবার সময় কম্পিউটারে চক্ষু পরীক্ষা বা ম্যানুয়াল চক্ষু পরীক্ষা করে আবার রোগীকে অক্ষর পড়িয়ে পাওয়ার কনফার্ম করা হয়। ঐ পাওয়ারটি চশমার প্রেসক্রিপশনে লেখা হয়। চশমার দোকানে ঐ প্রেসক্রিশন দেখে পাওয়ার তৈরি করেন এবং ফিটিং এর জন্য পাঠান। সুতরাং এতগুলো ধাপ পার হয়ে আসার সময় কোথাও কোন ভুল হলো কিনা সেটা দেখার জন্য চক্ষু বিশেষজ্ঞ বা তাঁর কোন সহযোগীকে দিয়ে পাওয়ার মাপার যন্ত্র ‘লেন্সমিটার’ এ পরীক্ষা করা উচিত।
চশমা একবার পরলে তা কি আবার ছাড়া যায়?
উত্তরঃ অনেকেই মনে করেন-চশমা একবার পরলে আর ছাড়া যায় না। আসলে কার চশমা লাগবে, কখন ছাড়া যাবে-এসবই নির্ভর করে ঐ ব্যক্তির পাওয়ার এর উপর। অনেক শিশুকে ছোটবেলায় মাথা ব্যথার জন্য সামান্য পাওয়ার দেয়া হয়। কিছুদিন ব্যবহারের পর তা নাও লাগতে পারে। অনেক শিশুর ছোটবেলায় প্লাস পাওয়ার লাগতে পারে, বড় হতে হতে তার ঐ পাওয়ার আর নাও লাগতে পারে। বেশিরভাগ শিশুই স্কুলে গিয়ে প্রথম ধরা পড়ে-দূরে বস্নাকবোর্ড দেখতে পারছে না।
এদেরকে মাইনাস পাওয়ার দেবার প্রয়োজন হয়। এরা যত বড় হবে-শরীরের সাথে সাথে চোখের আয়তনও বড় হয়। তখন চোখের পাওয়ারও স্বাবাবিক এর তুলনায় বেড়ে যায়। এদেরকে তখন ভালো দেখতে গেলে অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া পাওয়ার মাইনাস করতে হয় এবং চশমা অনেকদিন পরার প্রয়োজন হয়।
শিশু হোক বা বড় হোক, চোখ পরীক্ষা করে পাওয়ার এর প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই ব্যবহার করা উচিত। তা না হলে চোখের রেটিনার উন্নতি হবে না এবং ৬/৬ দৃষ্টি তৈরি হবে না।
ডাঃ এম নজরুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষু বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ এপ্রিল ২০০৮
চোখের যত সমস্যা
প্রশ্নঃ চশমার দোকান থেকে ‘রেডিমেড’ চশমা কিনে পরা কি ঠিক?
উত্তরঃ সাধারণতঃ বয়স ৩৫-৪০ বছর হলে অনেকেই নিকটে কম দেখতে শুরু করেন। তখন সহজেই এবং সস্তায় চশমার দোকান থেকে +১·০০ বা এর অধিক পাওয়ার এর চশমা কিনে ব্যবহার করতে শুরু করেন। ঐ চশমা দিয়ে বেশিরভাগ লোকই ভালো দেখতে পারেন এবং এতে চোখের কোন ক্ষতি হয় না। তবে ঐ ব্যক্তির জন্য শতকরা ১০০ ভাগ ঠিক পাওয়ার না মিললে-চোখে ১০০ ভাগ সঠিক দেখা যায় না এবং চোখের সহ নানা উপসর্গ হতে পারে। যে সকল ব্যক্তির দূরের ও পাওয়ার থাকে বা বাকা পাওয়ার (astigmatism) থাকে তাদের জন্য ঐ ‘রেডিমেড’ চশমা খুব ভালো কাজ করে না এবং আরামদায়কও হয় না। তাদের ক্ষেত্রে চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শে প্রয়োজনীয় চশমা তৈরী করে নেয়া ভালো।
প্রশ্নঃ শিশুদের চোখ কখন পরীক্ষা করানো উচিত?
উত্তরঃ যে সকল শিশুর চোখের কোন সমস্যা নেই, দেথার ও কোন সমস্যা নেই তাদের স্কুলে যাবার পূর্বে একবার পরীক্ষা করানো উচিত। কারণ চোখের অনেক রোগই আছে যা বাবা-মার নজরে নাও আসতে পারে। অনেক বড় হয়ে ঐ রোগ ধরা পড়লে- সঠিক চিকিৎসার সময় পার হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া যেসব শিশুর দেখতে সমস্যা হয়, নিকটে গিয়ে টিভি দেখে, চোখের পরিমাপ খুব ছোট বা বড় হলে, চোখের জন্মগত কোন ক্রুটি মনে হলে, চোখের মণিতে সাদা কোন দাগ মনে হলে, চোখ দিয়ে পানি পড়লে ইত্যাদি নানা সমস্যায়- যে কোন বয়সেই শিশুর চোখ পরীক্ষা করানো উচিত।
প্রশ্নঃ এক চোখে না দেখলে বা কম দেখলে কি গাড়ী চালানো যায়?
এক চোখে দেখে গাড়ী চালানো গেলেও তা করা উচিত নয়। গাড়ী চালাবার সময় সোজাসুজি এবং পাশাপাশি দেখা, ঠিক রং দেখা, দৃষ্টির গভীরতা (depth of perception) থাকা, রাতে ঠিক দেখা ইত্যাদির প্রয়োজন। একটি চোখ না থাকলে বা একটি চোখে বেশি কম দেখলে ঐ সকল প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব হয় না। সেজন্যে নিরাপদ ড্রাইভিং এর জন্য এক চোখে গাড়ী চালানো ঠিক নয়। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যবশতঃ অনেক গাড়ী চালক আছেন যারা এক চোখে দেখেন না। এদের গাড়ী চালাবার সময় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ডাঃ এম নজরুল ইসলাম
দৈনিক ইত্তেফাক, ০৫ এপ্রিল ২০০৮
চোখের ভাইরাসজনিত ইনফেকশন
সাধারণভাবে প্রচলিত কথা ‘চোখ ওঠা’ বলতে চোখ লাল হওয়া বুঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু চোখ লাল হওয়া একটি উপসর্গ মাত্র। বিভিন্ন কারণে চোখ লাল হতে পারে। যেমন-জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে, এডিনো ভাইরাসজনিত কারণে, হারপেস সিম প্লেক্স ভাইরাসজনিত কারণে, স্কেলেরার ইনফেকশনজনিত কারণে, ইউভিয়াল টিস্যু ইনফেকশনজনিত কারণ ইত্যাদি। তবে ভাইরাস কেরাটাইটিস বা হারপেম সিমপেক্স ভাইরাসজনিত ইনফেকশনই মুলত ভাইরাসজনিত ইনফেকশন। এ ধরনের ইনফেকশনে সাধারণত এক চোখ আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে খুব কম ক্ষেতে দুটি চোখই আক্রান্ত হয়। এতে চোখ খচখচ করে। সামান্য ব্যথা হয়। রোদে বা আলোতে তাকাতে কষ্ট হয় ও পানি পড়ে। সাধারণত ৭ থেকে ৮ দিনের মধ্যে উপসর্গগুলো কমে আসে। কিন্তু দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। মণি বা কর্নিয়াতে সাদা দাগ পড়ে যায়। খালি চোখে দেখে বোঝা যায় না।
বায়ো মাইক্রোস কপি যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে সুনির্দিষ্ট করে বোঝা যায়।
এটি একটি জটিল রোগ। দেরি করে চিকিৎসা করালে সম্পুর্ণ আরোগ্য লাভ অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তবে প্রাথমিক অবস্হায় চিকিৎসা নিলে খুব সহজেই সেরে যায়। কাজেই এক চোখ লাল হলে এবং ৩-৪ দিনের ভিতর অন্য চোখ আক্রান্ত না হলে মনে রাখবেন এটি কোনো সাধারণ রোগ নয়। শুধু এক চোখের প্রদাহ, জ্বালা-পোড়া, পানি পড়া, লাল হওয়া ইত্যাদি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
যেসব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তা হলো-ধুলাবালি, আগুন-আলো-রোদে কম যাওয়া, ময়লা-আবর্জনাযুক্ত সঁ্যাতসেঁতে জায়গায় না যাওয়া, পুকুর বা নদী-নালায় গোসল না করা, চোখে কালো চশমা ব্যবহার করা। সম্ভব হলে ১০ থেকে ১৫ দিন সম্পুর্ণ বিশ্রাম নেয়া এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া।
ডা. মোঃ মিজানুর রহমান
লেখকঃ কনসালটেন্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন
দৈনিক আমারদেশ, ০১ মার্চ ২০০৮
দাঁত তুললে চোখের ক্ষতি
আমরা দন্ত চিকিৎসকরা প্রায়ই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হই যে, দাঁত তুললে চোখের ক্ষতি হবে কিনা। এটি একেবারেই অমূলক এবং ভ্রান্ত একটি ধারণা। দাঁত প্রদাহ হলে ব্যথাটি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চোখে। পালপাইটিস (Pulpitis) নামক দাঁতের এই রোগটিই মূলত ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় রোগীদের নিকট। কেননা ব্যথাটি তখন অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে পাশের দাঁতে ব্যথা সে পাশে চোখের দিকে। আর এতেই অধিকাংশ ভুক্তভোগী রোগীগণ মনে করেন দাঁতের সাথে চোখের সম্পর্ক আছে। এছাড়াও উপরের দাঁতের শিকড়গুলো (Roots) চোখের কাছাকাছি অবস্থান-তাই এটিও রোগীদের দুর্ভাবনার অন্যতম একটি কারণ।
এই ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ভুল। কেননা দাঁত এবং চোখ দুটি আলাদা আলাদা স্নায়ুতন্ত্রের সাথে জড়িত। এদের স্নায়ুপ্রবাহ এবং রক্তপ্রবাহ দুটিই স্বতন্ত্র।
চোখের স্নায়ুপ্রবাহ হচ্ছে অপথালমিক ডিভিশন অব ট্রাইজেমিনাল নার্ভ এবং নিচের দিকে হচ্ছে ম্যাক্সিলারি ডিভিশন অব ট্রাইজেমিনাল নার্ভ। রক্ত প্রবাহিত হয় অপথালমিক এবং ল্যাক্রিমাল আর্টারি দ্বারা। অন্যদিকে উপরের পাটির দাঁতে স্নায়ুপ্রবাহ দেয়া হলো, অ্যান্টিরিয়র পোস্টিরিয়র, মিডল সুপিরিয়র নার্ভ। নিচের পাটিতে দেয় ইনফিরিয়র অ্যালভিওলার নার্ভ ব্রাঞ্চ অব ম্যান্ডিবুলার নার্ভ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, দাঁত এবং চোখ দুটি ভিন্ন ভিন্ন গঠনে সজ্জিত-যার একটির সাথে অপরটির কোন সম্পর্ক নেই।
লেখকঃ ডাঃ আসফিকা হোসেন জুঁই
দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০শে ডিসেম্বর ২০০৭
ডায়াবেটিসে চোখের আরও সমস্যা
ট্যারা চোখঃ দীর্ঘ সময় ধরে স্বল্প মাত্রার ডায়াবেটিসের জন্য অক্ষিপেশির অবশজনিত কারণে ট্যারা চোখ দেখা দিতে পারে। সাধারণত বয়স্ক রোগীরা এ সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে রোগী কয়েক দিন তীব্র মাথাব্যথায় ভোগেন, হঠাৎ করে দ্বৈত দৃষ্টির উপসর্গে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। দ্বৈত দৃষ্টি হচ্ছে একটি জিনিসকে দুটি দেখা। সাধারণত দেখা যায়, চোখের এ সমস্যায় আক্রান্ত রোগী নিজের অজান্তেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রয়েছেন।
ডায়াবেটিসের পরিচিত উপসর্গের অনুপস্থিতির জন্য চিকিৎসকেরাও এ অবস্থায় বিভ্রান্ত হতে পারেন। তাই বয়স্ক রোগীদের হঠাৎ সৃষ্ট ট্যারা চোখের চিকিৎসায় সতর্কতার সঙ্গে কারণ নির্ণয় করা উচিত। ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা তখন জরুরি হয়ে পড়ে। ডায়াবেটিসের কারণে হওয়া ট্যারা চোখের চিকিৎসা সহজ। ডায়াবেটিসের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ও দ্বৈত দৃষ্টির সমস্যা সেরে ওঠার জন্য ট্যারা চোখটি ঢেকে দেওয়াই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট। পুরোপুরি ভালো হতে তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগে। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে নয় মাস। রোগীদেরও তাই কিছুটা ধৈর্য ধরতে হয়। কেননা এ ক্ষেত্রে দ্রুত ভালো হওয়ার কোনো উপায় নেই।
চোখের প্রদাহজনিত জটিলতাঃ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের সঙ্গে চোখের বিভিন্ন ধরনের প্রদাহজনিত রোগও নিবিড়ভাবে জড়িত। ডায়াবেটিসের জন্য প্রদাহজনিত রোগের প্রবণতা যেমন বেশি থাকে, তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে সেসবের কার্যকর চিকিৎসা দেওয়াও সম্ভব হয় না। শুধু চোখের নয়, যেকোনো অঙ্গের প্রদাহ বা ইনফেকশনের জন্যই এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে চোখের প্রদাহজনিত রোগের চিকিৎসা দেওয়ার সময় ডায়াবেটিসের প্রসঙ্গটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। রোগীদেরও এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। কোনো প্রদাহে আক্রান্ত হলে অবহেলা না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ছানি রোগঃ আমাদের চোখের অভ্যন্তরে একটি লেন্স রয়েছে, যা দর্শন-প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই লেন্স কোনো কারণে অস্বচ্ছ হলেই ছানি রোগ হয়। আমাদের দেশে বয়স্কদের অধিকাংশই ছানি রোগ সম্পর্কে সচেতন। এ রোগ বয়স্কদের দৃষ্টি হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ। ডায়াবেটিসের রোগীরা দুভাবে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
এক· ডায়াবেটিসজনিত ছানি,
দুই· ডায়াবেটিসের দরুন ত্বরান্বিত বয়োবৃদ্ধিজনিত ছানি।
রোগীর দেহে চিনির পরিমাণ অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেলে চোখের লেন্সের বিপাক-প্রণালীতে জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষত দীর্ঘ সময় ধরে রক্তে চিনির মাত্রা ২০০ মিগ্রা/১০০ মিলি বা ততোধিক হলে ‘সোরবিটল’ অ্যালকোহলের আধিক্য দেখা দেয়, যার উপস্থিতি লেন্সের জন্য ক্ষতিকর। ফলে লেন্স অস্বচ্ছ হয়ে পড়ে। এ ধরনের ছানি অল্পবয়সী ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। রক্তে চিনির মাত্রার কার্যকর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ ধরনের ছানির প্রকোপ কমিয়ে আনা সম্ভব।
দ্বিতীয় প্রকারের ছানি ইনসুলিন-অনির্ভর ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের বয়োবৃদ্ধিজনিত ছানির প্রবণতা বেড়ে যায়। কারণ হিসেবে বলা হয়, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর চোখের লেন্স একই বয়সী স্বাভাবিক ব্যক্তির লেন্সের তুলনায় ১৫ বছর বেশি বয়সীর লেন্সের অবয়ব নিয়ে থাকে। অর্থাৎ যাঁর ছানি হওয়ার কথা ৫৫ বছর বয়সে, তিনি হয়তো চল্লিশেই ছানি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
লেখকঃ ডা· মো· শফিকুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষুবিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক প্রথম আলো, ১২ ডিসেম্বর ২০০৭
আইরিসের প্রদাহ
আইরিসের প্রদাহকে আইরাইটিস বলে। আর আইরিস এবং সিলিয়ারি বডির প্রদাহকে একত্রে আইরিডোসাইক্লিআইটিস্ বলা হয়।
কারণঃ
আঘাতজনিত কারণে যদি চোখ ছিদ্র হয়ে যায়
বিভিন্ন জীবাণুর সরাসরি সংক্রমণে
অ্যালার্জি
নির্দিষ্ট কারণ যেমনঃ টিউবারকুলোসিস, সিফিলিস প্রভৃতি।
উপসর্গঃ
দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যাওয়া
চোখে ব্যথা, যা রাতে গভীর হয়
চোখ থেকে পানি পড়া এবং
আলোক সংবেদনশীলতা
চিকিৎসক সাধারণত যে বিষয়গুলো খেয়াল করে থাকেন-
চোখ লাল হয়ে যাওয়া
কর্নিয়ার ওপরে কিছু কোষের অস্তিত্ব
আইরিসের বর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
পিউপিল ছোট হয়ে যাওয়া প্রভৃতি।
চিকিৎসাঃ দৈনিক তিন-চারবার গরম সেক দেয়া উচিত। রোগীকে রোদচশমা ব্যবহার করার পরামর্শ দিতে হবে। ১% এট্রোপিন আই ড্রপ বা অয়েন্টমেন্ট দৈনিক তিনবার ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত চোখটিকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। প্রদাহকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হাইড্রোকটিসোন আই ড্রপ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা ড্রপ এবং অয়েন্টমেন্ট দু’ভাবেই প্রয়োগ করা হয়। তা ছাড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা, ব্যথার জন্য ব্যথানাশক ওষুধ সেবন, বিভিন্ন জীবাণুর সংক্রমণ বন্ধের জন্য এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন এবং অবস্থা জটিল হলে সাবকনজাংটিভাল স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন দেয়া হয়।
জটিলতাঃ বিভিন্ন জটিলতার মধ্যে চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধি পাওয়া, সাইনেকিয়া, চোখের ছানি তৈরি হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
লেখকঃ ডা. সুমাইয়া নাসরীন লোপা
দৈনিক নয়াদিগন্ত, ০৬ জানুয়ারী ২০০৮
ছানির চিকিৎসায় ম্যানুয়াল ফ্যাকো
ঘটনা
স্বল্প আয়ের চিত্রশিল্পী তিনি। মফস্বলে থাকেন। দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে বেশ কিছুদিন হলো। চোখের চিকিৎসক দেখিয়ে জানতে পেরেছেন, চোখে ছানি পড়েছে। অস্ত্রোপচার করাতে হবে।
চিকিৎসকেরা বলেছেন, ‘ফ্যাকো করালে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাগবে।’ তাঁরা আরও বলেছেন, ‘ইদানীং ছানির অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে এক ধরনের লেন্স বেরিয়েছে, যা ব্যবহার করলে চশমার প্রয়োজনই পড়ে না! তবে এতে খরচ পড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।’ সেই বিশেষজ্ঞ (!) চিকিৎসকের মুখের দিকে বি্নয়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি। এ দেশেও ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে মানুষ ছানির অস্ত্রোপচার করায়!
চোখে অপ্রত্যাশিত ছানি পড়ার জন্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি। এবার কৌতূহলভরে চিকিৎসকের কাছে জানতে চান, ‘সত্যই কি ছানির অস্ত্রোপচারের পর কোনো চশমা লাগে না?’ এবার চিকিৎসক কথা ঘুরিয়ে বলেন, ‘না, তেমন একটা লাগে না।
তবে যারা পড়াশোনা করে বা নিকটদৃষ্টির কাজ করে, তাদের সামান্য পাওয়ারের চশমা লাগে।’ এবার চিত্রশিল্পী বিভ্রান্তিতে পড়েন। একটু আগেই চিকিৎসক বলছিলেন, ‘কোনো চশমাই লাগে না’, এখন বলছেন ‘লাগে’; তাহলে কোনটা সঠিক? তাঁর সাহস হয় না চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করে বিষয়টি আরও খোলাসা করে নিতে। এ ছাড়া নিজের সামর্থেøর বিষয়টিও মাথায় আসে। তিনি ভেবেছিলেন, হাজার দুয়েকের ভেতর চোখের চিকিৎসা সম্পন্ন করবেন; সেখানে ২০ হাজার টাকা জোগাড় করা তাঁর পক্ষে দুরূহ।
ছানির অস্ত্রোপচারের জন্য এত টাকা আসলেই কি প্রয়োজন? এ ছাড়া বেশি টাকা দিয়ে অস্ত্রোপচার করালেই চোখে ভালো দেখবেন-এ ধরনের ধারণা কি ঠিক? আমাদের দেশে ইদানীং চিকিৎসাসেবা যেন পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। বাজার-অর্থনীতির অনুষঙ্গ চিকিৎসাজগতের দুষ্ট গ্রহের মতো উপস্থিত। গণমাধ্যমে প্রচারিত টক শো, পত্রিকার বিজ্ঞাপন ইত্যাদি থেকে ‘ফ্যাকো’ শব্দটি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। চোখের চিকিৎসকেরাও তাঁদের ডিগ্রির সঙ্গে ‘ফ্যাকো সার্জন’ শব্দযুগল জুড়ে দিয়েছেন। ছানির অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রচারণায় মানবিক দৃষ্টিকোণে রোগীর প্রয়োজনের বিষয়টি দারুণভাবে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। ‘ফ্যাকো’ (Phaco) শব্দের অর্থ লেন্স। অংশীদারের চোখের ভেতরের লেন্সের গ্রিক নাম হচ্ছে ‘ফ্যাকো’।
ফ্যাকো সার্জন সেই হিসেবে চোখের লেন্সের সার্জন। স্বাভাবিক অবস্থায় চোখের ভেতরের লেন্স স্বচ্ছ থাকে। এই লেন্সের অস্বচ্ছ অবস্থাকে ছানি বলা হয়। সে হিসেবে ছানির অস্ত্রোপচারের চিকিৎসক ‘ফ্যাকো সার্জন’ হিসেবে অভিহিত হতে পারেন।
ছানির অস্ত্রোপচারের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। আলট্রাসাউন্ড পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ছানিটাকে গুলিয়ে বের করে আনার নাম ফ্যাকোইমালসিফিকেশন। যন্ত্রের মাধ্যমে ছানির অস্ত্রোপচারের এ পদ্ধতি যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁরা নিজেদের ‘ফ্যাকো সার্জন’ হিসেবে পরিচিত করেছেন; আর যন্ত্রটি ‘ফ্যাকো মেশিন’-এ রূপান্তরিত হয়েছে। এই যন্ত্রের বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বিভিন্নভাবে প্রচারের মাধ্যমে এ অস্ত্রোপচারকে সর্বাধুনিক পদ্ধতি আখ্যা দিয়ে আসছেন। প্রযুক্তিগত দিক থেকে ফ্যাকোইমালসিফিকিশেন যে আধুনিক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একে যেভাবে উপস্থাপন করে মুনাফা অর্জনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়।
কেননা ছানির অস্ত্রোপচারের অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ ছাড়া ফ্যাকোইমালসিফিকেশনই একমাত্র সেলাইবিহীন অস্ত্রোপচার নয়, সেলাইবিহীন বিকল্প পদ্ধতিও রয়েছে। ভারতসহ অনেক দেশেই সেই পদ্ধতি ম্যানুয়াল ফ্যাকো নামে পরিচিতি। এ পদ্ধতি ওইসব দেশে ব্যবহার করে অসংখ্য রোগীর দৃষ্টি ফেরানো গেছে। আমাদের দেশেও এ পদ্ধতিতে ছানির অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনো প্রচার নেই। ভারতের বিশ্বখ্যাত অরবিন্দ চক্ষু হাসপাতালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফ্যাকো সার্জারিতে প্রতি অস্ত্রোপচারে যন্ত্রপাতির ব্যয় এক হাজার ২০০ রুপি, সেখানে ম্যানুয়াল ফ্যাকোতে ব্যয় মাত্র ৪৬ রুপি।
এ পদ্ধতি কথিত ফ্যাকো সার্জারির মতো সেলাইবিহীন, দৃষ্টি-প্রদায়ক। এটি উন্নয়নশীল বিশ্বে ছানির চিকিৎসায় খুলে দিয়েছে নতুন দিগন্ত।
এ পদ্ধতি ফ্যাকো সার্জারির চেয়ে তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ। ফ্যাকো সার্জারিতে যেসব জটিলতা হয়ে থাকে, ম্যানুয়াল ফ্যাকোতে তা ওই মাত্রায় হয় না। এ পদ্ধতিতে সরকারি হাসপাতালে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে সার্জারির পুরো ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব, যা ইনস্ট্রুমেন্টাল ফ্যাকো সার্জারিতে চিন্তাই করা যায় না।
বাংলাদেশে ম্যানুয়াল ফ্যাকো সার্জারি লাগসই প্রযুক্তি, যা দেশের লাখ লাখ ছানিজনিত অন্ধজনের চিকিৎসায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ফ্যাকো সার্জারির জন্য জনপ্রতি যে ব্যয় হয়, তা দিয়ে ৩০ জন ছানি রোগীর চিকিৎসা এ পদ্ধতিতে সম্ভব।
অর্থাৎ একটি ফ্যাকো সার্জারির ব্যয় দিয়ে ৩০ জন পরিবারপ্রধানের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে ৩০টি পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সম্ভব। এই সাধারণ তথ্যটি মানুষের কাছে এত দিনে পৌঁছানোটা কি ঠিক হয়েছে?
শেষ কথা
শুরুতে উল্লিখিত রোগীর চোখে ম্যানুয়াল ফ্যাকো করা হয়েছে। শেষ পর্যêন্ত সরকারি হাসপাতালে সব মিলিয়ে এক হাজার টাকার অস্ত্রোপচার করিয়ে পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরেছেন তিনি। এত অল্প টাকায় যে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব, তা কিছুদিন আগেও ছিল তাঁর ধারণার বাইরে। আসুন না, সবাই মিলে এ রকম অসংখ্য রোগীর দৃষ্টি ফেরানোর কাজে শামিল হই!
ডা• মো• শফিকুল ইসলাম
চক্ষু বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম আলো, ১২ মার্চ ২০০৮
শিশুদের অন্ধত্ব চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
সরকারি সেবা বাড়ানো প্রয়োজন
‘আমি কোনো পাপ করি নাই, আল্লাহ আমার কপালে লিখছে, তাই দুই ছেলেই অন্ধ হইয়া জ্ন নিছে।’ এভাবেই নিজের মনকে শান্ত রাখেন জুবাইদা নাসরিন। পাবনার ভেলুপাড়া গ্রামের নাসরিন জানান, তাঁর দুই ছেলেরই জ্ন হয়েছে জ্নগত ছানি নিয়ে। বড় ছেলের বয়স ১২ ও ছোট ছেলের তিন। বড় ছেলের চোখের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে লাভ হয়নি। শুধু নাসরিন নন, আরও হাজার হাজার মা সন্তানের অন্ধত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর আই হেলথ এবং লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ২০০১-০৩ সালে করা একটি গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার শিশু কোনো না কোনোভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং এদের প্রায় ১২ হাজার শিশু ছানিজনিত কারণে অন্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে অন্ধ হতো না এরা। আরও ১০ হাজার শিশু অন্ধ হতো না, যদি তাদের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতো। শিশুর দৃষ্টি বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে, জুবাইদা নাসরিনই এর প্রমাণ। তিনি বড় ছেলের বেলায় অবহেলা করলেও ছোট ছেলে রওনকের বেলায় ছিলেন অনেক বেশি সচেতন। রওনকের ছানির অস্ত্রোপচার হয়েছে ঢাকার শান্তিনগরে চাইল্ড সাইট ফাউন্ডেশন (সিএসএফ) ও ওয়াহিদা মতিন মেমোরিয়াল ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে ওয়াহিদা মতিন মেমোরিয়াল সিএসএফ চাইল্ড ভিশন সেন্টারে। রওনককে শনাক্তকরণ, অস্ত্রোপচার, ফলো-আপ, যাতায়াত, হাসপাতালে থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় ব্যয় বহন করছে সিএসএফ। ওই সহায়তার ফলেই নাসরিনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে ছেলের চিকিৎসা করানোর। এ ভিশন সেন্টারে কথা হয় রিপন আহমেদের সঙ্গে। সাভারের ফুলবাড়িয়ার মোহাম্মদ আলী উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিপন জ্ন থেকেই ছানির সমস্যায় আক্রান্ত ছিল।
শান্তিনগরের ভিশন সেন্টারে বিনামূল্যে রিপনের ডান চোখে অস্ত্রোপচার করে লেন্স সংযোজন করা হয়েছে। ডান চোখে এখন পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে। বাঁ চোখে আবছা দেখতে পায় সে। এখানে কর্তব্যরতরা জানান, রিপনের বাঁ চোখের অবস্থা আশাব্যঞ্জক নয়। বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা এবং দেরি করায় এ চোখে অস্ত্রোপচারেও তেমন ভালো ফল পাওয়া যাবে না।
সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্লাইন্ড মিশনের মাধ্যমে চাইল্ড সাইট ফাউন্ডেশনের সহায়তায় রিপনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক সময় অভিভাবক বুঝতেই পারেন না যে শিশুটি চোখের গুরুতর সমস্যায় আক্রান্ত। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাদানকারী চিকিৎসকেরাও অনেক সময় ছানিসহ চোখের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিতকরণে সময় অপচয় করেন। যখন অভিভাবকেরা সমস্যা অনুধাবন করেন, তখন শিশুকে নিয়ে কোথায় যাবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চোখের আলো হারিয়ে একটি শিশু জীবনের তরে পরিবার ও সমাজের বোঝা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা সরকারি সেবা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে শিশুরা চোখের সেবা পাচ্ছে, যা দেশের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
দেশে বর্তমানে শিশু চক্ষুবিশেষজ্ঞের সংখ্যাও খুব কম-মাত্র নয় থেকে ১০। ২০০০ সালে সরকার আন্তর্জাতিক কর্মসূচি ‘ভিশন ২০২০’-এ অঙ্গীকার করেছে প্রতিরোধযোগ্য অন্ধত্ব নিরসনের।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিশু বিভাগের প্রধান ডা• জামাল নিজামুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের চোখের বিষয়ে মানুষ সচেতন হচ্ছে। সরকারি অবকাঠামোর ভেতরে শিশুদের চক্ষুসেবা দেওয়ায় সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি দেশের প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশুদের চক্ষু বিষয়ে একটি বিভাগ চালু করার ওপর গুরুত্ব দেন।
এ ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে এসেছে বেসরকারি সংগঠনগুলো। অরবিস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহায়তায় পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল, খুলনা, দিনাজপুর, ময়নসিংহ ও মৌলভীবাজারে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতিগুলোতে শিশুচক্ষু বিভাগ পরিচালিত হচ্ছে।
মানসুরা হোসাইন
প্রথম আলো, ২২ অক্টোবর ২০০৮
অলস চোখ থেকে শিশুর অন্ধত্ব
আমাদের চোখ কোনো জিনিসের ছবি তুলে স্মায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দেয়। মস্তিষ্ক তখন বলে দেয় এটা কিসের বা কার ছবি বা এটির রং, আকৃতি কেমন। যদি এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে বুঝতে হবে, চোখে সমস্যা আছে। অলস চোখ বা এমব্লায়োওপিয়া চোখের একটি মারাত্মক রোগ, যা প্রধানত শিশুর চোখের ছবি গ্রহণের ক্ষমতাকে ব্যাহত করে। ফলে শিশুটি ওই চোখ দিয়ে কিছুই দেখতে পায় না। যদি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে সঠিক চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে শিশুটির দৃষ্টিশক্তি আর কখনোই ফিরে আসে না।
অলস চোখ কী
চোখের সবচেয়ে ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ আবরণটির নাম হচ্ছে রেটিনা। এটি আলোক সংবেদনশীল কিছু কোষ দিয়ে গঠিত। আমরা যা কিছুই দেখি না কেন, তার একটি ছবি রেটিনায় তৈরি হয়। রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষগুলো শিশুর জ্নের পর চোখে আলো ঢুকে সেই আলোর উপস্থিতিতে পরিপূর্ণতা লাভ করতে থাকে। জ্নের পর যদি চোখে ঠিকমতো আলো না ঢোকে, তাহলে রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষগুলোর বৃদ্ধি পরিপূর্ণভাবে হয় না। ফলে ওই চোখের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং কাজ না করার কারণে সেটি অলস চোখে পরিণত হয়।
কারণ
এ রোগের প্রধান ও একমাত্র কারণ হচ্ছে শিশুর চোখে ঠিকমতো আলো প্রবেশ করতে না পারা। আলো প্রবেশ না করার কারণ হলো-
-- জ্ন থেকে বা জ্নের পর শিশুর চোখে ছানি হলে। ছানির কারণে চোখের লেন্স ঘোলা হয়ে যায়, ফলে চোখে পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করে না। ফলে রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষগুলোর বৃদ্ধি হয় না। যে চোখে ছানি আসে, শিশু তাকে কাজে লাগায় না, ফলে চোখটি অলস হয়ে যায়। দুই চোখে ছানি হলে দুটিই অলস হয়ে যায়।
-- জ্ন থেকে অথবা জ্নের পর চোখের আকৃতিগত পরিবর্তনের কারণে দৃষ্টিশক্তি কম থাকে। ফলে আলো ঢুকতে বাধা পায়। যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে ধীরে ধীরে চোখ অলস হতে থাকে।
-- টেরা চোখা মানুষ সব সময় দুটি চোখ দিয়ে একটি জিনিস দেখে, কিন্তু চোখ টেরা থাকলে শিশু ভালো চোখটি দিয়ে সব সময় দেখার চেষ্টা করে, টেরা চোখটি কাজে লাগায় না। ফলে টেরা চোখটি অলস হয়ে যায়।
--জ্নগতভাবে চোখের পাতা নিচের দিকে পড়ে গেলে চোখের যে স্বচ্ছ অংশ (কর্নিয়া) দিয়ে আলো প্রবেশ করে, তা যদি ঢেকে যায়, তাহলে পর্যাপ্ত আলো চোখে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে চোখের রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষগুলোর বৃদ্ধি হয় না এবং দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। যে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়, শিশুরা সেটিকে ব্যবহার না করে সব সময় ভালো চোখটি ব্যবহার করে; ফলে অন্যটি অলস চোখে পরিণত হয়।
যেসব সমস্যা হয়
-- অলস লোকের যেমন কোনো কাজ থাকে না, তেমনি অলস চোখেরও কাজ থাকে না। অলস চোখের কারণে সৃষ্ট প্রধান সমস্যা হচ্ছে টেরা চোখ।
টেরা চোখঃ চোখ টেরা হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে অলস চোখ। দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার ফলে যে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে, শিশু সেটি ব্যবহার করে না। ফলে সে চোখটি যেকোনো এক দিকে বেঁকে যায়। নির্দিষ্ট একটি বয়সসীমার মধ্যে চিকিৎসার মাধ্যমে অলস চোখটি সচল করে তুললে টেরা চোখ ভালো হয়ে যায়।
চিকিৎসা
-- যে কারণগুলোর জন্য চোখ অলস হয়, সেগুলোর চিকিৎসা করালে অলস চোখ ভালো করা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে বয়স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাত বছরের কম বয়সী শিশুকে চিকিৎসা করালে সম্পূর্ণ সুস্থ হয় ওঠে।
-- জ্নগতভাবে যদি শিশুর চোখে ছানি থাকে, তাহলে দ্রুত ছানির অপারেশন করাতে হবে। বয়স সাত বছর পেরিয়ে গেলে অপারেশন করেও তেমন ফল পাওয়া যায় না। ধরা যাক, পাঁচ বছর বয়সের একটি শিশুর জ্নগত ছানি অপারেশন করে চোখে নতুন লেন্স লাগিয়ে দেওয়া হলো, তার পরও সে ভালো দেখছে না। এর কারণ হলো-তার চোখটি অলস হয়ে গেছে। তখন তার ভালো চোখটি কাপড় দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়। অলস চোখটিকে দিয়ে বেশি করে কাজ করানো হয়। বেশি কাজ করানোর জন্য চোখের রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষগুলো আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
-- জ্নগতভাবে শিশুর দৃষ্টিশক্তি কম থাকলে খুব দ্রুত চোখের ডাক্তার দেখিয়ে চশমা ব্যবহার করতে হবে। যদি চশমা দিয়েও কাজ না হয়, তাহলে বিশেষ ধরনের চোখের ব্যায়াম (অ্যাকুলেশন থেরাপি) করে দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। অর্থাৎ যে চোখটি ভালো আছে, তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখে অলস চোখটিকে দিয়ে কাজ করানো হয়। ফলে অলস চোখটি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
প্রতিরোধ
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হচ্ছে, শিশু কিছু বুঝে ওঠার আগেই অলস চোখ তার দৃষ্টিশক্তিকে চিরতরে নষ্ট করে দেয়। কারণ, অলস চোখের চিকিৎসা সাত বছরের নিচে থাকলেই করা সম্ভব। এ বয়সসীমার মধ্যে রেটিনার আলোক সংবেদনশীল কোষগুলোর বৃদ্ধি ঘটে। এ জন্য অভিভাবকের উচিত, শিশুকে স্কুলে পাঠানোর আগে একবারের জন্য হলেও চোখের ডাক্তার দেখানো; বিশেষ করে যেসব হাসপাতালে শিশুদের চোখ দেখার আলাদা ব্যবস্থা আছে।
ডা· শীতেস চন্দ্র ব্যানার্জী
চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশু চক্ষুরোগ বিভাগ বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল, খুলনা
প্রথম আলো, ৪ জুন ২০০৮
নিকট দৃষ্টিতে ল্যাসিক
যার সারা জীবন চশমা লাগেনি তার চল্লিশের পর নিকটে দেখার চশমা লাগাটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম। ইংরেজিতে বলে চৎবংনুড়ঢ়রধ আর বাংলায় চোখে ‘চালশে ধরা’। জন্ম থেকে চল্লিশ বছর (কারো ৩৭ কারও বা ৪৫, বাধা ধরা কোনো নিয়ম নেই) পর্যন্ত আমাদের চোখের ভেতরের লেসটা, যেটা সব দৃশ্যবস্তুকে ফোকাস করে পরিষ্কার দেখতে সাহায্য করে। এটা একটা অটো ফোকাস ক্যামেরার মতো কাজ করে এবং আকাশের প্লেন থেকে হাতের ঘড়ির কাঁটা পর্যন্ত নিমিষেই ফোকাস করতে পারে। তবে পার্থক্য এই যে ক্যামেরার লেস একটু আগে বা একটু পেছনে গিয়ে ফোকাস করে কিন্তু আমাদের চোখের লেসটা আগে পিছে না গিয়ে নিজেই আশপাশের কয়েকটা পেশির সাহায্যে মোটা-পাতলা হয়ে ফোকাস করতে সাহায্য করে। কিন্তু বয়সের সঙ্গে অন্যান্য সব অঙ্গের মতো লেসটাও একটু শক্ত হয়ে আসে এবং নিজে থেকেই মোটা-পাতলা হওয়ার শক্তি আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলে, যেজন্য চশমার পাওয়ার বাড়তে থাকে।
এ পর্যন্ত নিকট দৃষ্টির জন্য একমাত্র চশমাই ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। চশমা ছাড়া ভালো দেখার জন্য মাত্র গত ক’বছর পর্যন্ত এসেছে কন্ট্যাক্ট লেস ও সব শেষে ল্যাসিক। আর ল্যাসিক আসার পর মানুষ কন্ট্যাক্ট লেসের কথা বেশি বলছে না কারণ এ লেস খোলা পরার ঝামেলা ও প্রতিদিন পরিচর্যা করার সমস্যা অনেক। তাছাড়া নিকট দৃষ্টির জন্য কন্ট্যাক্ট লেস হয় না, অবশ্য অনেকে এক চোখে নিকটে দেখার জন্য কন্ট্যাক্ট লেস ব্যবহার করেন-যাকে বলে গড়হড়ারংরড়হ। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
এবার আসা যাক ল্যাসিকের কথায়। নিকট দৃষ্টির জন্য ল্যাসিক কীভাবে সাহায্য করতে পারে। প্রথম কথা হলো চল্লিশের পর আমাদের চোখের পাওয়ার দুরে এবং কাছে এক নয়। প্রত্যেক দুরত্বের জন্য একেকটা আলাদা পাওয়ার, যেমন দুরের জন্য একটা কম্পিউটারে কাজ করার জন্য একটা (Mid-distance) ও নিকটের জন্য একটা। সাধারণ জীবনের জন্য এই তিনটাই যথেষ্ট। প্রথমে মনে রাখতে হবে ল্যাসিক (ও কন্ট্যাক্ট লেস) শুধু একটা পাওয়ার ঠিক করতে পারে। তাই প্রশ্ন হলো ল্যাসিক চালশে পড়া চোখে (Presbyopic) কীভাবে সাহায্য করতে পারে।
দুই চোখের পাওয়ার কম-বেশি Correction করিয়ে রোগীকে খুশি করা বর্তমানে খুবই একটা সাধারণ বিষয়। এই বয়সের দলে দুই শ্রেণীর মানুষ আছেঃ
(ক) দুরে চশমা লাগে না শুধু নিকটে লাগে
(খ) কারো দুরে ও নিকটে দুটোই লাগে।
এবার বলব এই দু’শ্রেণীর মানুষের জন্য দু’রকমের ব্যবস্হার কথা। সবশেষে জানবেন ক ও খ গ্রুপের কার জন্য কোনটা ভালো। এই দুই ধরনের চিকিৎসায়ই দুই চোখের পাওয়ার সম্পুর্ণ ঈড়ৎৎবপঃ না করে দুই দিকে কম-বেশি ঈড়ৎৎবপঃরড়হ করিয়ে দুরে কাছে নধষধহপব করিয়ে দেয়া। দেখা গেছে এতে চল্লিশোর্ধ মানুষরা অসম্ভব খুশি। এই দুই পদ্ধতি হলো
ক. মনোভিশন
এক কথায় এক চোখে দুরের জন্য আর অন্য চোখে কাছের জন্য ব্যবহার করা। এটা করালে দুরে এক চোখে খুব ভালো ও নিকটে অন্য চোখে খুব ভালো দেখা যায়। এই যে দুরে বা নিকটে এক চোখে দেখা সে দেখা দুই চোখ মিলে পরিষ্কার দেখার মতো এত আরামদায়ক যদিও নয় তবুও দেখা গেছে, যে সব সময় চশমা বয়ে নিয়ে বেড়ান থেকে মুক্তি, চশমাবিহীন ও ঝামেলাহীন সামাজিক জীবন বহু মানুষের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য। আপনি এই ধরনের চিকিৎসা করাবেন কিনা এটা সম্পুর্ণ নির্ভর করে আপনার নিজের চাহিদার ওপর, এখানে ডাক্তারের কোনো অভিমত নেই। তবে চোখের ব্যাপারে এটা খারাপও নয়। আর একটা কথা, দুই চোখে সমান দেখার জন্য আপনি একটা চশমা নিজের কাছে রেখেও দিতে পারেন, যদি বেশিক্ষণ লেখাপড়া বা চোখের কাজ করতে চান তাহলে মনোভিশনে চোখে একটু ক্লান্তি আসতে পারে। তখন দুই চোখে সমান দেখার জন্য চশমাটা সাময়িকভাবে ব্যবহার করতে পারেন। মনোভিশন চশমাবিহীন সামাজিক জীবনের জন্য খুবই জনপ্রিয়। বিশেষ করে যাদের দুরের চশমা এমনিতেই লাগে না।
খ. পাওয়ার কম-বেশি করান
এবার বলব বিশেষ করে তাদের কথা যাদের দুরে এবং কাছে দুটোতেই মোটামুটি পাওয়ার আছে। এরা নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে যে কোনো একটা পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে-
মনোভিশন অথবা দু’চোখেই দুরের জন্য পুরো পাওয়ার ঈড়ৎৎবপঃরড়হ করাতে পারেন এবং শুধু নিকটের জন্য চশমা (দু’চোখেই)। মনে রাখবেন, দুরের পাওয়ার ঠিক করালে নিকটের পাওয়ারও আগের থেকে কমে অর্ধেক হয়ে যাবে, দু’দিকেই লাভ। এতে সুবিধা হলো, সকালে উঠেই আর চশমা হাতড়াতে হবে না। দুরে দেখতে চশমা লাগবে না। নিকটেও মোটামুটি বড় লেখা পড়তে পারবেন যেটা আগে একেবারেই পারতেন না। তবে খুব ছোট লেখা পড়তে একটা চশমা পকেটে রাখতে হবে।
আসল কথা হলো ল্যাসিকের মাধ্যমে দুরের পাওয়ার সম্পুর্ণ সারিয়ে দেয়ার পরও আমরা এখন চোখের যে কোনো নিকটের পাওয়ারকে কম-বেশি করিয়ে রোগীকে খুশি করতে পারি।
চোখের পাওয়ার সম্বন্ধে নানান কথা খুলে বলার পরও সবচেয়ে ভালো ব্যবস্হা হলো ডাক্তারের চেম্বারের চেয়ারে বসে চোখের সেই সব পাওয়ার একের পর এক বসিয়ে ডাক্তার সাহেব যদি ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন যে অপারেশন করালে ঠিক কি হবে তাহলে আপনার জন্য ফবপরংরড়হ নেয়া সহজ হবে। তাই ল্যাসিক সেন্টারে গিয়ে এসব পাওয়ারের খুঁটিনাটি আলোচনা করা সবচেয়ে নিরাপদ।
সবশেষে মনে রাখবেন ল্যাসিক করিয়ে চল্লিশোর্ধ বয়সে যাদের দুরে ও নিকটে দু’রকমের পাওয়ার তাদেরও মোটামুটি চশমা থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব।
ডা. রশীদ হায়দার
আমার দেশ, ১লা এপ্রিল ২০০৮
কন্ট্যাক্ট লেন্স নিয়ে নানা কথা
প্রশ্নঃ কন্টাক্ট লেন্স কি চোখের জন্যে ক্ষতিকর?
উত্তরঃ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করে এবং নিয়ম মেনে চললে কন্টাক্ট লেন্স চোখের জন্য ক্ষতিকর নয়।
আমাদের দেশে অনেকেই আছেন উপযুক্ত পরীক্ষা না করেই চশমার দোকান থেকে কন্টাক্ট লেন্স নিয়ে ব্যবহার করেন এবং অনেক সময় নানা সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শের জন্য আসেন। ধরা যাক একজন রোগীর চোখের পানির পরিমাণ কম। তাকে পরীক্ষা না করেই দোকান থেকে কন্টাক্ট লেন্স দেয়া হলো। ২/১ দিনের মধ্যেই ঐ রোগীর চোখে কর্নিয়ায় আলসার বা ক্ষত হয়ে যাবে এবং সঠিক চিকিৎসা না হলে দৃষ্টির ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
আজকাল অনেক উচ্চ পানি ধারণক্ষমতাসহ কন্টাক্ট লেন্স পাওয়া যায়, যা চোখের জন্য আরামদায়ক। এছাড়া কিছু ডিসপোজঅ্যাবল কন্টাক্ট লেন্স আছে যা মাত্র ১-২ মাস ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। যার ফলে চোখের কোন জটিলতা হয় না বললেই চলে।
প্রশ্নঃ কন্টাক্ট লেন্স একবারে কতদিন চোখে রাখা যায়?
উত্তরঃ সাধারণ কন্টাক্ট লেন্সগুলো দিনের বেলা চোখে পরা হয় এবং রাত্রে ঘুমের পূর্বে নির্দিষ্ট কেসের মধ্যে খুলে রাখা হয়। লেন্সের প্রকারভেদে ১২-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত এই লেন্স পরে থাকা যায়।
এক্সটেন্ডেড ওয়ার কন্টাক্ট লেন্স (ঋর্সণভঢণঢ ষণটর ডমর্ভটর্ড ফণভ্র) নামে এক ধরনের কন্টাক্ট লেন্স পাওয়া যায়- যাতে পানি ধারণক্ষমতা অনেক বেশি থাকে। এসব কন্টাক্ট লেন্স একবার চোখে লাগিয়ে ৭-১৪ দিন পর্যন্ত রাখা যায়। এর বেশি রাখলে চোখের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে।
১-২ সপ্তাহ পর ঐ লেন্সগুলো ফেলে দিতে হয় বলে বছরে অনেক সংখ্যক কন্টাক্ট লেন্সের প্রয়োজন হয় এবং লেন্সের মূল্যও অনেক বেড়ে যায়। আমাদের দেশে এই জাতীয় লেন্সের ব্যবহার অনেকটা সীমিত।
চোখের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করলে ডেইলি ওয়ার লেন্স বা দৈনিক রাত্রে খুলে রাখার লেন্সই ভালো।
প্রশ্নঃ রঙিন কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহারে চোখে কোন অসুবিধা হয় কি?
উত্তরঃ সাধারণ কন্টাক্ট লেন্সের উপরে এক ধরনের রং করে রঙিন কন্টাক্ট লেন্স তৈরী করা হয়ে থাকে। যেহেতু রং একটি কেমিক্যাল, এজন্য অনেকের চোখে ঐ রং-এর জন্য এলার্জি বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
যারা সৌন্দর্য বাড়াবার জন্য রঙিন কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করতে চান তাদের জন্য প্রথম কয়েকদিন ট্রায়াল হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কোন সমস্যা না হলে তখন ঐ ব্রান্ডের কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করা যেতে পারে।
যাদের চোখে পাওয়ার আছে তাদের জন্য প্রথমে সাধারণ কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করে- ২য় ধাপে রঙিন+পাওয়ার কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রশ্নঃ অল্প আলোতে পড়লে কি চোখের ক্ষতি হয়?
উত্তরঃ অল্প আলোতে পড়লে চোখের কোন ক্ষতি হয় না। তবে কোনকিছু দেখা না গেলে, জোর করে পড়ার চেষ্টা করলে চোখের উপর চাপ পড়ে বা আইস্ট্রেন হয়। কিছুক্ষণ এভাবে পড়লে মাথাব্যথা বা চোখে ব্যথা হতে পারে। সুযোগ থাকলে স্বাভাবিক আলোতে পড়াশুনা করাই শ্রেয়।
প্রশ্নঃ আমার চোখে চশমা লাগলে কি আমার বাচ্চাদেরও লাগবে?
উত্তরঃ হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রেই লাগতে পারে। বিশেষ করে আপনার যদি নিকট দৃষ্টি বা মায়োপিয়া থাকে তাহলে আপনার ছেলে-মেয়ে কারও কারও ঐ একই সমস্যা হতে পারে। আপনি যদি এমন কাউকে বিয়ে করেন যার আপনার মতই চশমা লাগে কিংবা আপনার বংশের কাউকে বিয়ে করেন তাহলে আপনাদের ছেলে-মেয়েদের চশমা লাগার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যাবে।
ডাঃ এম নজরুল ইসলাম,
চক্ষু বিশেষজ্ঞ, বারডেম।
দৈনিক ইত্তেফাক, ০৩ মে ২০০৮
0 Comments:
Post a Comment
Subscribe to Post Comments [Atom]
<< Home